খুব বেশি আগের কথা নয়। পত্রিকার পাতা উল্টালে কিংবা টেলিভিশনের চ্যানেল ঘোরালেই ৫০ বছর আগের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ইতিহাসের একপেশে কাসুন্দি মাখিয়ে বিরোধী মত দমনের এক অন্য রকম দমন পীড়নের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে দেখা যেত সেসময়ের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার দোসরদের। তার সাথে তাল মিলিয়ে মিথ্যার বেসাতি ছড়াতো এক শ্রেণীর মিডিয়া। বিষয়টি নিয়ে জনমনে চরম বিরক্তির উদ্রেক হলেও এক প্রকার নিরূপায় হয়েই সবাই গলধঃকরণ করতেন সেসব কর্মকান্ড। আর এর মাধ্যমেই নিজেদের সমস্ত অপরাধের পাহাড় আড়াল করা ও অপকর্ম হালাল করার এক নগ্ন প্রচেষ্টা চালিয়ে যেত স্বৈরাচারীনী হাসিনা ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। প্রতিবেশী বন্ধুরূপী আধিপত্যবাদী ভারতের দেয়া সকল রোগের সেরা মহৌষধ ‘লাকি মলম’ এর যথেচ্ছ ব্যবহার করা হতো যত্রতত্র। ‘লাকি মলম’ সকল রোগের মহৌষধ হিসেবে কতটুকু কার্যকর ছিল তা সবারই জানা। মূলতঃ এই মলম সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে ভারতের আধিপত্যবাদ কায়েমের বয়ান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাতিকে বিভক্তির দিকে ঠেলে দিতে। আর সে বয়ান ছিল ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, বিপক্ষের শক্তি নিরূপণ’। যে বয়ানের ভিত্তিতে শাহবাগে কথিত গণজাগরণ মঞ্চের নামে কায়েম করা হয়েছিল এক আজব পরিস্থিতির। যাকে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেছিলেন ‘ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি’।
সত্যিই ফ্যাসিবাদ গুটি গুটি পায়ে দখল করে নিয়েছিল এদেশের রাজনীতির ময়দান। স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছিল মানুষ। স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছিল নির্লজ্জভাবে। মানুষ টু টা শব্দ করতেও ভয় পেত এই ভেবে যে কখন কোথা থেকে সাদা পোষাকের বাহিনী তুলে নিয়ে যায়। গুম, খুন, হত্যা, সন্ত্রাস, কারাগার, নির্যাতন হয়ে উঠেছিল এই জনপদের নিত্যদিনের সঙ্গী। কারও ওপর জুলুম চালানোর মনস্থ করলে কিংবা কারও উপর চালিয়ে দেয়া জুলুমের বৈধতা দেয়ার প্রয়োজন হলেই তাকে ‘স্বাধীনতা বিরোধী’ ‘রাজাকার’ ‘পাকিস্তানপন্থী’ কিংবা ‘স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি’ ইত্যাদি যে কোন একটি ট্যাগ লাগিয়ে দিলেই কেল্লা ফতেহ। আর এভাবেই বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল খুনী হাসিনার সকল জুলুম, শোষণ, লুটপাট আর অপকর্মের।
স্বৈরাচারের সকল জুলুম, শোষণ আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর একটি ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের পথে হাঁটতে পারতো সবাই। কেননা ২৪ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে দল-মত নির্বিশেষে ময়দানে নেমে এসেছিল সবাই। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আধিপত্যবাদী, ব্রাহ্মণ্যবাদী, উগ্র হিন্দুত্ববাদী ভারতের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে একসাথে গর্জে উঠেছিল এদেশের জনগণ। তৎকালীন আওয়ামী সরকারের দেশবিরোধী সকল ষড়যন্ত্র ও উম্মাহকে ভারতের গোলামীর জিঞ্জির পরানোর অভিলাষ রুখে দিয়ে এক নতুন আজাদির স্বপ্নে রাজপথে জীবন বিলিয়ে দিয়েছিল ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, জনতা। কিন্তু মাত্র আট মাস না পেরোতেই সেই গণবিপ্লবের ঐক্যবদ্ধ জাতিকে ভাঙনের খেলায় মেতে উঠেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে থাকা কোনো কোনো উপদেষ্টা। অবশ্য তারা ইদানিং নিজেদের উপদেষ্টা বলে পরিচয় দেয়ার চেয়ে ‘সিটিং মিনিস্টার’ বলে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন।
রাজনীতির নানা মেরুকরণ চলছে চলবে এটা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। বরং গুমতন্ত্রের মানসকণ্যা হাসিনার শোষণে মানুষ রাজনীতির যে চর্চা বাধ্য হয়ে ভুলতে শুরু করেছিল, অন্তবর্তী সরকারের আগমনে জনগণ স্বতঃস্ফুর্তভাবে তার অনুশীলন শুরু করেছে এটা গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে দারুন ইতিবাচক একটি দিক। এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের তথাকথিত একজন ‘সিটিং মিনিস্টার’ ও তার আশির্বাদপুষ্ট নব্য নেতারা ৭১ এর প্রসঙ্গ টেনে নতুন করে নতুন বোতলে পুরনো মদ ঢালতে শুরু করলেন। জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে ওঠার স্বপ্ন এদেশের মানুষ দেখতে শুরু করেছিল, সে আশার গুড়ে যেন বালি ঢেলে দেয়া হলো নির্মম ও নির্লজ্জভাবে। ন্যায় ও ইনসাফের রাজনীতির বদলে নতুন করে যেন শুরু করা হলো দোষারোপ আর ট্যাগিং এর রাজনীতি। এটা একরাশ হতাশার খবর। কথিত ‘সিটিং মিনিস্টারগণ’ যে অদৃশ্য ইশারায় মুহুর্তেই ‘চিটিং মিনিস্টার’ এ পরিণত হবে তা কে কবে ভেবেছে! রাজপথে এখনও যেন লেগে আছে রক্তের দাগ, বাতাসে যেন এখনও ভাসে পোড়া লাশের গন্ধ, এখনও শিশুরা হেলিকপ্টারের শব্দে আৎকে ওঠে এই ভেবে – এই বুঝি গুলি ছুঁড়বে কেউ! অথচ সব ভুলে কার দেখানো কোন লালসায় জাতি বিভক্তের এই মহড়া শুরু হলো?
স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ও তার পুরো মন্ত্রীসভার একটা মুদ্রাদোষ ছিল। আর তা হলো যে কোনো ঘটনা মধ্যেই তারা ‘জামায়াত-শিবির’ খুঁজে বের করার আপ্রাণ চেষ্টা করতো। সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেও সে জামায়াত-শিবিরকে খুঁজে পেয়েছিল। আর খুঁজে পেয়ে সেখানেই ক্ষান্ত থাকেনি, শেষ পর্যন্ত জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধও করেছিল। অবশ্য এই নিষিদ্ধ করার পর শেখ হাসিনা ক্ষমতার মসনদে ১০ দিনও থাকতে পারেনি। দেশ ছেড়ে পালিয়ে প্রাণ রক্ষা হয়েছে তার।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের প্রাণের দাবিতে আন্দোলন করছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। বিশেষ করে খুনী হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর তারা নিজেদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য দল-মত নির্বিশেষে রাজপথে অবস্থান করেছে। এটা কোনো নতুন ঘটনা ছিল না। দিন যত গড়িয়েছে জবির শিক্ষার্থীরা দাবি আদায়ের প্রয়োজনে তারা ধীরে ধীরে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার দিকে এগিয়ে এসেছে। জনৈক ‘সিটিং মিনিস্টার’ গিয়েছেন তাদের সাথে কথা বলতে। এরই মধ্যে একজন একটা প্লাস্টিকের পানির বোতল ছুড়ে মেরেছে। একেবারে ‘সিটিং মিনিস্টার’ এর মাথায় গিয়ে লাগে বোতলটি। খুনী হাসিনার মতই গো গো করে সরে গেলেন তিনি। সাংবাদিকদের সামনে শিবিরকে ইঙ্গিত করে এক বক্তব্য দিয়ে শেষে মিডিয়া ও প্রশাসনকে একপ্রকার অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে দিলেন যেন তারা তার ইঙ্গিতকৃত দলকেই খুঁজে বের করে।
আল্লাহর ইশারা বুঝা এত সহজ না। চ্যানেল২৪ এর ক্যামেরায় ধরা পড়লো জবি শিক্ষার্থী হুসনাইনের ফুটেজ, যে কিনা কথিত সেই ‘সিটিং মিনিস্টার’ এর মাথায় পানির বোতল ছুড়েছিল। খুনী হাসিনাকে আমরা দেখতাম- একদিকে সে মানুষ খুন করতো, অন্যদিকে নিহতের পরিবারকে গণভবনে ডেকে নিয়ে সান্তনা দিয়ে ফটোসেশন করে মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিত। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী থেকে শুরু করে সর্বশেষ জুলাই বিপ্লবের শহীদ আবু সাঈদের পরিবার পর্যন্ত এই একই চিত্র দেশের মানুষ দেখেছে। কিন্তু গত ৮ মাসে দেশের মানুষ এমন কিছু দেখেনি। কিন্তু এভাবে আর কতদিন! ‘ক্ষমতা না জনতা’ শ্লোগান দিয়ে যারা ক্ষমতায় বসেছেন, সেই তারাই দেখালেন ক্ষমতা। প্লাস্টিকের বোতল ছুড়ে মারা ছেলেটা ছাত্রশিবিরের সাথে সম্পৃক্ত কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাকেও হাসিনার স্টাইলে ডিবি পুলিশ দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ৬ ঘন্টা যাবত তার মোবাইল নিয়ে গবেষণা করে ডিবি নাকি ছাত্রশিবিরের সাথে দূরতম কোন সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায়নাই। বলতে হবে ছেলেটার ভাগ্য ভালো। ছাত্রশিবিরেরও ভাগ্য ভালো। ছেলেটা যদি শিবির হতো তবে কোনোভাবেই তার একটা বোতল ছুড়ে মারার অধিকার থাকতো না। এমনকি অন্যান্য অনেকের মত ডিবির কাছ থেকে সে মায়ের কোলে ফেরত না আসতো তবে কিছুই করার ছিল না। ভাগ্য ভালো হলে হয়তো কোন গোপন বন্দীশালা তথা আয়নাঘরে বেঁচে থাকতো। এই বোতল ছোড়ার অপরাধে ‘সিটিং মিনিস্টার’ ছেলেটা পুরো শিবিরকেই হাসিনার মত নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও করতে পারতো। কিন্তু এতকিছু আর দেশের মানুষকে দেখতে হয়নি। শেখ হাসিনা যেমন তার বাহিনী দিয়ে অপছন্দের লোকদের দমনের পর সিলেক্টেড ভিক্টিমদের সাথে সপরিবারে ফটোসেশন করে নিজেকে মহৎ প্রমাণ করার চেষ্টা করতো, একইভাবে ৬ ঘন্টা যাবত শিবিরের সাথে সংশ্লিষ্টতা খুঁজে না পেয়ে বোতল নিক্ষেপকারী ছেলেটাকে তার মায়ের হাতে তুলে দিয়ে ফটোসেশন করে নিজের বাসায় দাওয়াত দেয়ার খবর মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
বলা যায় না, অদূর ভবিষ্যতে ‘লাকি মলম’ এর বিজনেস রক্ষায় কথিত ‘সিটিং মিনিস্টার’দের হয়তো আয়নাঘরও থাকবে। ক্ষমতা আঁকড়ে ধরতে এসবের বিকল্প নেই। ইতিহাসের কাসুন্দি আর আয়নাঘর সমানতালে না চালিয়ে যেতে পারলে জনগণের কণ্ঠরোধ করা যায় না। চোখে দেখা ইতিহাস অন্তত তাই বলে।
লেখক: ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্ট