এক বছর অতিক্রান্ত হলো। ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ জুলাই। রক্তক্ষয়ী গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ এক বছর পার করেছে। এই একটি বছর বাংলাদেশের জন্য নেহাত ৩৬৫ দিন ছিল না, এটি ছিল বিশাল এক পালাবদল, বাঁকবদল। জুলাই বিপ্লবের সময়টা এবং এই এক বছর ছিল শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের মুখোশ উন্মোচনের ও প্রকৃত মানুষ চেনারও।
জুলাই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশের শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনে সুস্পষ্ট বিভাজন সৃষ্টি হয়। সাবেক হাসিনা সরকার, আওয়ামী লীগ, সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো এবং পতিত স্বৈরাচারের সুবিধাভোগীরা জুলাই আন্দোলনকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেন। তাদের মধ্যে একটা বেশ বড় অংশ বিদেশে আছে। ফলে তারা নিশ্চিন্তে পিঠ বাঁচিয়ে লিখতে পারেন। তারা বছর ধরে জুলাই আন্দোলনের ছাত্র-জনতাকে ‘সন্ত্রাসী’, ‘শিবির কর্মী’, ‘জঙ্গি’ ইত্যাদি আখ্যা দিয়েই চলেছেন। তাদের লেখা পড়লে, ভুয়া তথ্য পড়লে মনে হয় হাসিনা পালিয়ে যাওয়া মাত্র যেন ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’, ‘স্বাধীনতা’ ও ‘গণতন্ত্র’ চলে গেছে। এই আফসোসকারীদের মধ্যে যে কবিরা আছেন, তারা জুলাই-আগস্টে পুলিশের গুলিতে এবং আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলায় তরুণ, শিশু ও কিশোররা শহীদ হওয়ার পরও এক লাইন কবিতা লেখেননি, এক ফোঁটা চোখের পানিও ফেলেননি। তাদের সবচেয়ে বড় সাপোর্ট এসেছে কতিপয় ভারতীয় মিডিয়ার ভুয়া খবর থেকে। ভারতীয় কিছু মিডিয়া রীতিমতো কোমর বেঁধে বাংলাদেশকে ‘জঙ্গি রাষ্ট্র’ প্রমাণ করতে মিথ্যা ও বানোয়াট খবর পরিবেশন করেছে।
ত ১৫ বছরে আওয়ামী সরকারের ভালো-মন্দ অনেক কর্মকাণ্ডই রয়েছে। লেখক-কবিদের মধ্যে অনেকে আওয়ামী, অনেকে বামপন্থি ও অনেকে বিএনপির রাজনীতি সমর্থন করেছেন এবং এখনো করেন। এটা হতেই পারে। দোষের নয়। সব মানুষেরই নিজস্ব রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা রয়েছে। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক চিন্তা, ধর্মীয় চিন্তা, মতাদর্শ কোনোকিছু দিয়েই জুলাই-আগস্টে নিরস্ত্র ছাত্রজনতার ওপর গুলি চালানো সমর্থন করা যায় না। হিটলারের সময়ও অনেক লেখক তাকে সমর্থন করেছিলেন। তারা ফুয়েরার মিথে বিশ্বাস করতেন। এখন হাসিনা মিথে বিশ্বাস করলে আপনিও তাদের মতোই আবর্জনা ছাড়া কিছুই নন।
প্রশ্ন জাগতে পারে, চোখের সামনে ছাত্র-জনতার লাশ দেখেও, আয়নাঘরের ভয়াবহতা দেখেও, হাসিনার নেতা-পাতিনেতা ও চ্যালাচামুন্ডাদের দুর্নীতি দেখেও কেন কবি-লেখকদের একটি অংশ এখনো হাসিনার পক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গরম করছেন? এই মাঠ গরমকারীদের বেশিরভাগই ১৫ বছরে বিস্তর সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন। পদ-পদবি, পুরস্কার, বিদেশ গমন, বাড়ি-গাড়ি, টিভি প্রোগ্রাম, সরকারি সুযোগ-সুবিধা ও টাকা করেছেন এই আমলে। তাদের মধ্যে যারা নিজস্ব যোগ্যতায় পুরস্কার পেয়েছেন, তারা কিন্তু চুপচাপ আছেন বা জুলাই আন্দোলনকে সমর্থন করছেন, অথবা কিছুই করছেন না। কারণ তারা বিক্রি হননি। যারা অযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও সুযোগ-সুবিধা, টাকা-পয়সা, পদ-পুরস্কার ইত্যাদি পেয়েছেন, তারাই বেশি চিৎকার করছেন। কারণ তারা এসব পদপদবি ও পুরস্কারের কাছে নিজের মস্তিষ্কটি বিক্রি করেছেন।
এবার আসি বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে সংস্কারের বিষয়ে। জুলাই বিপ্লব আমাদের স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশ দিয়েছে। এখন দরকার স্বৈরাচারী আমলের চিন্তাভাবনা, পশ্চাৎপদ মানসিকতা, অন্য দেশের মুখাপেক্ষী মনোভাব, ক্ষমতার তোষণ, পদপদবি ও পুরস্কারের লোভে সাহিত্যের নামে আবর্জনা সৃষ্টি এবং শিল্প-সাহিত্য অঙ্গনের লুটতরাজ ও দুর্নীতি থেকে বেরিয়ে এসে নতুন ধারা, নতুন মানসিকতা এবং নতুন আলোয় উদ্ভাসিত সাহিত্য সৃষ্টি। বাংলাদেশে সাহিত্যের নামে যে কত রকম অনাচার, ক্ষমতা তোষণ ও দুর্নীতি হয়েছে, তা বাংলা একাডেমির দিকে তাকালেই বোঝা যায়। বাংলা একাডেমিতে চাকরি করে, রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচার করে, দলীয় গুন্ডার মতো আচরণ করে এবং ক্ষমতাসীনদের পদলেহন করে অনেকেই বাগিয়ে নিয়েছেন সাহিত্যের পুরস্কার।
জাতীয় কবিতা পরিষদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নামে ক্ষমতার পদলেহন এবং ব্যক্তিগত সুবিধা হাসিলের খেলা চলেছে নগ্নভাবে। শুধু তাই নয়, ভিন্ন দেশের দালাল, চাটুকার ও পঞ্চম বাহিনীতে পরিণত হয়েছেন বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য জগতের কথিত রথী-মহারথীরা।
এখন প্রয়োজন এসব আবর্জনা পরিষ্কার করে নতুনভাবে শিল্প-সাহিত্য অঙ্গনকে গড়ে তোলা। জুলাই বিপ্লব যে ছাত্র-জনতার চরম আত্মত্যাগের ফসল, সেই চেতনাকে রক্ষা করার জন্য দরকার সাংস্কৃতিক বিপ্লব ও শিল্পসংস্কার।
গণবিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লবের একটা আশঙ্কা থেকেই যায়। কারণ দীর্ঘ সময় স্বৈরাচারের শাসনে দেশ থাকলে সেখানে স্বৈরাচারের মদতপুষ্ট ও সুবিধাভোগী একদল দালালচক্রের সৃষ্টি হয়। তারা ইসলামোফোবিয়া ছড়ানোর চেষ্টা করেছে। শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পরও তাদের আস্ফালন বন্ধ হয়নি। এখনো তারা দারুণভাবে সক্রিয়। তাদের প্রতিহত করার জন্য দরকার সাংস্কৃতিক বিপ্লব, সাংস্কৃতিক পরিশোধন।
জুলাই বিপ্লবের চেতনা হচ্ছে বৈষম্যহীন, দুর্নীতিমুক্ত ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ার চেতনা। জুলাই বিপ্লবের চেতনা হলো আধুনিক ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ার চেতনা। সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার চেতনা। গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার চেতনা। স্বৈরাচার প্রতিহত করার চেতনা। হাসিনা সরকারের ১৫ বছরে জাতিকে বিভক্ত করার যে অপকৌশল অবলম্বন করা হয়েছে, তা থেকে মুক্ত হয়ে ইনক্লুসিভ জাতি গঠনের চেতনা । এই চেতনাকে ধারণ করে এখন সাংস্কৃতিক বিপ্লব শুরু করতে হবে। আমরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। বাঙালি, পাহাড়ি, মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান—আমরা সবাই বাংলাদেশি। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে, নিজস্ব শিল্প ও জীবনাচার রয়েছে। বাংলাদেশের এই নিজস্ব সংস্কৃতিকে ধারণ করে আমাদের শিল্প-সাহিত্যকে এগিয়ে যেতে হবে। এই শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির কথা আমাদের নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্যের কথা, আমাদের সম্পদের কথা ও শক্তির কথা আমাদের সাহিত্যে প্রতিফলিত করাই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রধান কাজ।
পাশাপাশি আমাদের শিল্প-সাহিত্যের প্রতিষ্ঠানগুলোকে দালালমুক্ত ও চাটুকারমুক্ত করা প্রয়োজন। বাংলা একাডেমি , শিল্পকলা একাডেমি ও শিশু একাডেমিকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা প্রয়োজন। এতে মন্ত্রণালয়ের ছোট-বড় আমলাদের সামনে ‘জি হুজুর’ করার নষ্ট ধারা থেকে আমরা মুক্তি পাব। এসব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ফান্ড দরকার, পরিচালনা পরিষদ দরকার। তাহলে বছরে বছরে দলীয় মুখপত্রের ভূমিকা পালন আর চাটুকারিতার আবর্জনা মার্কা বই প্রকাশের ঘৃণ্য ধারা থেকে আমরা মুক্ত হতে পারব।
দরকার আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে গভীর গবেষণা চালিয়ে যাওয়া, আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে তুলে ধরা। দরকার দাস মানসিকতার অবসান। সেজন্যই চাই আমাদের একান্ত নিজস্ব জাতীয় সংস্কৃতির চর্চা।
জুলাই বিপ্লবের এক বছর অতিক্রান্ত হচ্ছে। এই এক বছরে আমরা শিল্পসাহিত্য জগতে কতদূর অগ্রসর হয়েছি, তার মূল্যায়ন করা দরকার। জুলাই বিপ্লবের সময়কার সৃষ্টিগুলোকে সংরক্ষণ করা দরকার। পাশাপাশি এক বছরে ভোল পাল্টানো, সুবিধাভোগী এবং নয়া বিপ্লবীদের বিষয়েও সতর্ক হতে হবে।