২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের অন্যতম হটস্পট ছিল রাজধানীর উত্তরার আজমপুরের বিএনএস সেন্টার এলাকা। গত বছরের ১৫ জুলাই ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরীহ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলে পড়ে। বিশেষ করে ছাত্রীদের ওপর অমানবিক বর্বতা চালানোয় ক্ষোভে ফেটে পড়ে পুরো দেশ।
সারা দেশের মতো উত্তরা ও টঙ্গী-গাজীপুরের স্কুল-কলেজ, মাদরাসা এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে উত্তরার আজমপুর এলাকা। কেবল ১৭ জুলাই বাদে প্রতিদিনই বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা বিএনএস সেন্টারের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানান। এ সময় ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার’; ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’Ñএসব স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে রাজপথ ।
শহীদ আবু সাঈদের দুই হাত প্রসারিত অবস্থায় গুলি করে হত্যার ঘটনা গোটা দেশ তথা বিশ্ববিবেককে নাড়িয়ে দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৮ জুলাই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সর্বস্তরের মানুষ যোগ দিলে সেটি গণআন্দোলনে রূপ নেয়। আজমপুরের বিএনএস সেন্টারের সামনে স্বৈরাচার হাসিনা ও তার পেটোয়া বাহিনীর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন ছাত্র-জনতা।
ওই দিন বিকালে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বুলেট কেড়ে নেয় নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার প্রাণ। রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ ও অলিগলি । সেদিন উত্তরাবাসী প্রত্যক্ষ করে অঘোষিত এক যুদ্ধ। চোখের সামনে একের পর এক নিরস্ত্র ছাত্র-জনতা নিহত হওয়া ও আহতদের আর্তনাদ উত্তরার সর্বস্তরের মানুষের মনে দাবালন প্রজ্বলিত হতে থাকে। ক্ষুব্ধ জনতা বিকালে আবদুল্লাহপুর, হাউস বিল্ডিং, রাজলক্ষ্মী কমপ্লেক্স ও জসিমউদ্দীন রোডসহ আশপাশের অলিগলিতে নেমে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। এলাকাবাসীর দাবি, ১৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত আন্দোলনে উত্তরা এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী ক্যাডারদের হাতে শতাধিক ছাত্র-জনতা নিহত হন। আহত হন কয়েকশ।
ওই দিন উত্তরার আজমপুরের আমিন কমপ্লেক্সের সামনে ইউটার্নে বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে স্নাইপারের গুলি কপালে বিদ্ধ হয়ে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের শিক্ষার্থী মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ নিহত হন। আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকে পানি পান করিয়ে ক্লান্ত শরীরে মহাসড়কের ইউটার্নে বসলে পুলিশের স্নাইপারের বুলেট তাকে চিরতরে স্তব্দ করে দেয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সুবাদে এখনো ভেসে আসে শহীদ মুগ্ধের কণ্ঠÑ‘পানি লাগবে, পানি।’
এদিকে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে দমাতে পুলিশ, এপিবিএন, র্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয় উত্তরা, টঙ্গী ও গাজীপুরের ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা। ঢাকা-১৮ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) হাবিব হাসান ও গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের সশস্ত্র ক্যাডাররা প্রতিটি গলির মুখে সশস্ত্র অবস্থান নিয়েছিল।
১৯ জুলাই শুক্রবার বিশাল হোন্ডা ও গাড়িবহর নিয়ে উত্তরার হাউস বিল্ডিং এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালালে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার পাল্টা হামলায় গুরুতর আহত হন গাজীপুর সিটি করপোরেশেনর সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম, কাউন্সিলর শিপু খান, মীর ওসমান গনি কাজল। এ সময় বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের পিএস ও গাছা থানা যুবলীগ নেতা জুয়েল মোল্লাকে বিবস্ত্র করে বেদম পিটিয়ে মেরে হাউস বিল্ডিং এলাকার বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের বটগাছে প্রায় তিন ঘণ্টা বুঝিলে রাখে। পরে বিজিবির একটি দল গিয়ে গাছ থেকে তার লাশ উদ্ধার করে।
এরই ধারাবাহিকতায় গণঅভ্যুত্থানে পাল্টাপাল্টি হামলা চলতে থাকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত। একপর্যায়ে ফ্যাসিবাদী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গোপনে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেও একদল অতিউৎসাহী ও বিপথগামী পুলিশ সদস্য এবং ছাত্রলীগের হায়েনারা ছাত্র-জনতার বিজয় মিছিলেও নির্বিচারে গুলি চালায়।
মুহুর্মুহু গুলি, টিয়ারশেল, রাবার বুলেট, র্যাবের হেলিকপ্টার থেকে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণÑউত্তরার সেসব দিনের ঘটনা এখনো চোখে ভাসে স্থানীয় বাসিন্দাদের। চোখের সামনে নির্বিচারে ছাত্রদের ওপর গুলি, আহতদের রাস্তায় পড়ে কাতরানো, প্রশাসন ও আওয়ামী গুন্ডাবাহিনীর বাধায় হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসাসেবা না দেওয়ার দুঃসহ স্মৃতি এখনো উত্তরাবাসীর হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে।
উত্তরার আজমপুর এলাকার ভাসমান ব্যবসায়ী আলী আজম জানান, জুলাই আন্দোলনে আজমপুরের বিএনএস সেন্টার এলাকা ছিল অগ্নিগর্ভ। ১৮ জুলাই থেকে প্রায় প্রতিদিনই নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার সঙ্গে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
ছাত্র-জনতার ইটপাটকেলের জবাবে ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্বিচার গুলি, স্নাইপারের গুলি, রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল ও বন্দুকের গুলি। ১৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট বিকাল পযর্ন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষ করে কিছু পুলিশ সদস্যের সশস্ত্র নির্মমতা এখনো পীড়া দেয় দেশবাসীকে । পুলিশের বন্দুকের নল থেকে ফুটপাতের হকাররাও রক্ষা পাননি বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা।
উত্তরায় জুলাই আন্দোলনের সমন্বয়ক ছিলেন আশুলিয়ার ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ছাত্র তালহা সরদার। তিনি টঙ্গী তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসার ফাজিল দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আন্দোলনের দুঃসহ স্মৃতি তুলে ধরে তালহা বলেন, ‘আমরা আগের রাতে ম্যাপ নিয়ে বসতাম। তারপর টিমের সবাইকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করে উত্তরার আজমপুরের বিএনএস সেন্টার এলাকায় অবস্থান নিয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী মরণপণ আন্দোলন করি।’
জুলাই আন্দোলনে মায়েদের (আন্টিদের) অনেক ভূমিকা রয়েছে উল্লেখ করে তালহা বলেন, ‘তারা তাদের স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও ইউনিভার্সিটিতে পড়া ছেলেদের শতভাগ মৃত্যুর আশঙ্কার কথা জেনেও হাসিমুখে আমাদের সঙ্গে আন্দোলনে পাঠাতেন । নিষেধ করলে তারা বলতেন, ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন আন্দোলনে গিয়ে আমাদের ছেলেরা শহীদ হলেও আপত্তি নেই। তবে লাশটি নিয়ে এসো।’ মায়েদের এমন অমিয় বাণী আমাদের আন্দোলনকে আরো বেগবান ও ত্বরান্বিত করে।’
তিনি বলেন, ‘ক্লান্ত-শ্রান্ত ও ক্ষুধার্ত-পিপাসার্ত দেহে যখন আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন এলাকার বাসিন্দারা বিশেষ করে মায়েরা বাসা থেকে পানি, পিৎজা, শিঙাড়া, বার্গার, ফলসহ বিভিন্ন শুকনা খাবার ফেলে ইশারা-ইঙ্গিতে আমাদের খেতে বলতেন। আন্দোলন চালিয়ে যেতে আমাদের উৎসাহ দিতেন।’
ত্রিমুখী হামলার মধ্যে কর্মসূচি চালিয়ে যেতে হয়েছে জানিয়ে তালহা সরদার বলেন, ‘আন্দোলনের সময় আমরা প্রায়ই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী ক্যাডার এবং সাদা পোশাকধারী সশস্ত্র পেটোয়া বাহিনীÑত্রিমুখী আক্রমণের শিকার হয়েছি। প্রতিদিন আসরের আজানের সময় পুলিশ হিংস্রভাবে আক্রমণ করতে।’
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ১৮ জুলাই বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে আমিন কমপ্লেক্সের ইউটার্নের রোড ডিভাইডারে বসে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকালে স্নাইপারের গুলি এসে আন্দোলনের অগ্নিপুরুষ মীর মুগ্ধের কপালে বিদ্ধ হয়। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সেখান থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
উত্তরার বিএনএস সেন্টার এলাকার আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক লাবিব মোহন্নাত আমার দেশকে বলেন, মূলত আন্দোলন শুরু হয় ১৬ জুলাই। ওই দিন সকাল থেকে আমরা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক দখল করে স্লোগানে স্লোগানে রাজপথ কাঁপিয়ে তুলি। উত্তরায় রাজপথ দখলের বিষয়টি ফ্যাসিস্ট সরকারের জন্য একটি অ্যালার্মিং বিষয় ছিল। দেশের অন্যান্য স্থানে ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালাতে সক্ষম হলেও শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের মুখে উত্তরায় ছাত্রলীগ তেমন কোনো সুবিধা করতে পারেনি। পরে ১৮ জুলাই উত্তরার বিএনএস সেন্টারের সামনে হাজার হাজার শিক্ষার্থী রাজপথ দখলে নিলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জিরো টলারেন্সের হুমকি দেওয়া হয়। পরে সকালে পুলিশ কয়েকটি সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে আন্দোরনরত শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। এতে হিতে বিপরীত হয়।
লাবিব মোহন্নাত বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়লে সর্বস্তরের মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে আন্দোলনে যোগ দেন। আন্দোলন দমাতে ব্যর্থ হলে একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে যোগ দেয় আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), র্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনী। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হওয়ার আগেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আন্দোলনকারীদের ওপর হিংস্রভাবে হামলে পড়ে এবং নির্বিচারে গুলি চালায়। ওই দিনই (১৮ জুলাই) পুলিশের গুলিতে বিএনএস সেন্টারের সামনে চার আন্দোলনকারী নিহত হন। আমরা উত্তরা এলাকায় নিহত ১০২ জনের তালিকা করেছিলাম। এর মধ্যে নিহত অনেকের তালিকা আমরা করতে পারিনি।’