- চোখে গুলি খাওয়া শিক্ষার্থীদের বয়স ছিল ১৪ থেকে ২৫ বছর
- কেউ কেউ এক চোখ, কেউ আবার দুই হাতে দুচোখ ধরে ছিল
- ১৮ জুলাই ছিল একটি রক্তস্নাত দিন
জুলাই আন্দোলনে আহত রাজধানীর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া ১১ জন দুই চোখের দৃষ্টি চিরতরে হারিয়েছেন। আর ৪৯৩ জনের এক চোখের আলো চিরদিনের জন্য নিভে গেছে। ২৮ জন দুই চোখে এবং ৪৭ জন এক চোখে দৃষ্টিস্বল্পতায় ভুগছেন।
সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ দেওয়া জবানবন্দিতে এসব কথা বলেন ইনস্টিটিউটের রেটিনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাকিয়া সুলতানা নীলা। জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে সারা দেশে চালানো হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এ সাক্ষ্য গ্রহণ করে।
শেখ হাসিনা ছাড়া এ মামলার অপর দুই আসামি হলেনÑসাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এ মামলায় শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল পলাতক। আর পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এই মামলায় রাজসাক্ষী হয়েছেন। শুনানির সময় ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে সাক্ষীদের জেরা করেন পলাতক আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন।
ট্রাইব্যুনালে দেওয়া জবানবন্দিতে ডা. নীলা বলেন, ‘৪, ৫ ও ৬ আগস্ট আমরা অসংখ্য আহত রোগী গ্রহণ করি, যাদের চোখে অপারেশন করতে হয় ।’ তিনি বলেন, গত বছর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ১৭ জুলাই থেকে আমাদের হাসপাতালে রোগী আসা শুরু হয়। ওইদিন আমরা বুলেটবিদ্ধ পাঁচজন রোগী পেয়েছিলাম। ১৮ জুলাই ছিল একটি রক্তস্নাত দিন। ওইদিন দুপুরের দিকে আমার কাছে খবর আসে হাসপাতালে অনেক আহত রোগী এসেছে। ওইদিন প্রায় ১০০ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়। এর বাইরে আনুমানিক আরো ১০০ রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। পরে আমি জরুরি বিভাগে এসে একটি ভয়াবহ চিত্র দেখতে পাই।
ডা. জাকিয়া সুলতানা নীলা বলেন, যারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছিল, তাদের বয়স ১৪ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। তাদের কেউ কেউ এক হাত দিয়ে এক চোখ, দুই হাত দিয়ে দুই চোখ ধরে ছিল। ওইদিন রাত ৯টায় আমরা ১০টা টেবিলে অপারেশন করতে থাকি। ১৯ জুলাই প্রায় একই চিত্র দেখতে পাই। ওইদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ১০ পর্যন্ত ১০টা টেবিলে অস্ত্রোপচার চলতে থাকে। আমাদের হাসপাতালে যারা চিকিৎসার জন্য এসেছিলেন, তাদের অধিকাংশ বুলেট দ্বারা আহত হন। অধিকাংশ রোগীর কর্ণিয়া ছিদ্র হয়ে গেছে, তাদের চোখের ভেতরের সাদা অংশ ছিদ্র হয়ে যায়, অনেকের চোখ ফেটে গিয়েছিল। চোখের রেটিনায় আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ায় রক্তক্ষরণ হচ্ছিল।
ডা. জাকিয়া সুলতানা নীলা বলেন, ওই সময় রোগীরা ভীতসন্ত্রস্ত ছিলেন। নিরাপত্তার কারণে অনেক রোগী তাদের নাম-ঠিকানা গোপন করে ছদ্মনাম দিয়েছে। মোবাইল নম্বর ভুল দিয়েছে, তাদের পরিচয় ভুল দিয়েছে।
জুলাই আন্দোলনে শহীদ মারুফ হোসেনের বাবা ফুচকা ও চটপটি বিক্রেতা ইদ্রিস বলেন, ‘আমার ছেলে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ত। সময় পেলেই গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে আমাকে সহযোগিতা করত। ১৯ জুলাই সকাল সাড়ে ৯টায় আমার ছেলে মারুফ আন্দোলনের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। তার সঙ্গে ছিল তার মামা ফয়সাল। জুমার নামাজের পর তারা বাসায় ফিরে এলে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করি। এ কথা বলেই তিনি কাঁদতে থাকেন। পরে বেলা সাড়ে ৩টায় আবার বের হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর তার মামা আমাকে ফোন করে জানায়, রামপুরা ব্রিজের ওপর থেকে পুলিশ, বিজিবি ও ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করছে। পৌনে ৬টার দিকে ফোন করে জানায় মারুফ গুলিবিদ্ধ হয়েছে বাড্ডা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে। তখন তাকে এএমজেড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
ইদ্রিস বলেন, মারুফের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় ঢাকা মেডিকেলে নিতে বলে সেখানকার চিকিৎসকরা। পথে রামপুরা ব্রিজের ওপর আওয়ামী লীগ, পুলিশ, বিজিবি মিলে আমার ছেলেকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সটি আটকায়। তখন মারুফের শরীরে অক্সিজেন লাগানো ছিল, সে বেঁচে ছিল। ১৫-২০ মিনিট ধরে রেখে পুলিশ জানায়, ‘সে মারা গেছে, তাকে হাসপাতালে নেওয়ার দরকার নেই।’ আমার ছেলের গুলিবিদ্ধ স্থানটি তখন গামছা দিয়ে পেঁচানো ছিল। পুলিশ রাইফেলের বাট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখে। তখন আমাদের ছেলে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল।
জুলাই শহীদ মারুফ হোসেনের বাবা বলেন, সেখান থেকে সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয় ছেলেকে। এরপর ৭টা ২০ মিনিটের দিকে সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ কথা বলতে বলতে আদালতে কাঁদতে থাকেন ইদ্রিস। তিনি আরো বলেন, ছেলের লাশ নিয়ে যেতে চাইলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পোস্টমর্টেম ছাড়া দিতে চায়নি। দুদিন পর ২১ জুলাই পোস্টমর্টেম করে আমার ছেলে লাশ হস্তান্তর করে। পুলিশি বাধার কারণে ছেলের লাশের পোস্টমর্টেম করতে দেরি হয়েছে। বাড্ডা থানার ওসি তার এলাকায় এমন ঘটনা ঘটেনি বলে অস্বীকার করেন। পূর্ববাড্ডার কবরস্থানে ছেলের লাশ দাফন করা হয়।
ছেলের হত্যাকাণ্ডের জন্য নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান কামাল, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, স্থানীয় সংসদ সদস্য ওয়াকিল উদ্দিন এবং মাঠে থাকা কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর আলম ও বিজিবি কর্মকর্তা রেদোয়ানের বিচার চান ইদ্রিস।
ট্রাইব্যুনালে আরো সাক্ষ্য দেন জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টউটের পরিচালক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী । চতুর্থ সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আমেনা বেগম। তিনি বলেন, লক্ষ্মীপুরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন গত বছর ১৬ জুলাই আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুরোদমে শুরু হয়। হাসিনা যখন শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে বকা দেন, তখন এ আন্দোলন আরো চাঙা হয়ে ওঠে। এরপর ২৯ জুলাই সকালে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা স্থানীয় উপজেলা পরিষদ বাগবাড়ী মোড়ে জড়ো হন। এ সময় পুলিশের সঙ্গে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসীরা ছাত্রদের ওপর চড়াও হয়ে ব্যাপক মারধর করে। তারা মেয়েদের ওপরও হামলা করে। আন্দোলন যখন চূড়ান্ত মুহূর্তে ৪ আগস্ট লক্ষ্মীপুর বাগবাড়ী মোড় এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীরা যখন ঝুমুর চত্বরে উপস্থিত হয়, তখন মাদাম ব্রিজ দিক থেকে সশন্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীরা গুলি করতে করতে এগিয়ে আসে।
এ সময় আমরা ৩০ থেকে ৪০ জন শিক্ষার্থী মাদাম ব্রিজের দিকে এগিয়ে গেলে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের গুলিতে আমার পাশের একজন ছাত্র রাস্তায় পড়ে যায়। পড়ে তার নাম জেনেছি সাদ আল আফনান। এরপর সন্ত্রাসীরা আমাকে ধাওয়া করে ধরে ফেলে এবং লাঠিসোঁটা ও ইট দিয়ে নানাভাবে মেরে আহত করে। পরে দুজন আন্দোলনকারী আমাকে লক্ষ্মীপুর সরকারি হাসপাতালে পৌঁছে দেয়। হাসপাতালে দুদিন ভর্তি থাকার পর বাড়িতে যাওয়ার পর শুনি সেদিন লক্ষ্মীপুরে চার-পাঁচজন শহীদ হন। আহত হন দুই শতাধিক আন্দোলনকারী। শিক্ষার্থী আমেনা আক্তার এসব ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ সংশ্লিষ্টদের ফাঁসি দাবি করেন।
ট্রাইব্যুনালের পঞ্চম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন কুমিল্লার দেবীদ্বারে শহীদ আব্দুর রাজ্জাক রু্বেলের মা হাসনা বেগম। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে ৪ আগস্ট সকাল ১০টায় নাশতা খেয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে আন্দোলনে যায়। বেলা দেড়টায় স্থানীয় একজন জানায়, আমার ছেলে আন্দোলনে আহত হয়েছে। এ কথা জানার পর আমি দৌড়ে ঘটনাস্থল দেবীদ্বার বারেরা রোডের আজগর আলী স্কুলের কাছে যাই। সেখানে প্রচুর রক্ত দেখতে পাই। পরে আমাকে দেবীদ্বার সরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে আমার ছেলের লাশ দেখে বারবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। পরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তাফিজ সরকার নগদ সাত লাখ টাকা ও দুটি দোকান দেওয়ার লোভ দেখিয়ে কোনো মামলা না করতে বলে।’
হাসনা বেগম জানান, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা সালাহ উদ্দিনসহ আওয়ামী সন্ত্রাসীরা তার ছেলে হত্যায় জড়িত।
ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, গাজী এসএইচ তামিম, বিএম সুলতান মাহমুদ ও ফারুক আহাম্মদ প্রমুখ । এক সময় অপর প্রসিকিউটররা উপস্থিত ছিলেন। এদিকে এ মামলায় পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে জেরায় ছিলেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন।
এদিকে এ মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে রাজসাক্ষী হওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন আজ সাক্ষ্য গ্রহণের সময় কাঠগড়ায় হাজির ছিলেন। মামলায় এখন পর্যন্ত ২৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়েছে ।