ফরিদপুরের একসময়ের ক্ষমতাধর সংসদ সদস্য ও ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আত্মীয় মজিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে নিক্সন চৌধুরী বর্তমানে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থপাচার, জমি দখল, টেন্ডারবাজি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিস্তৃত অভিযোগে তোলপাড় শুরু হয়েছে রাজনৈতিক মহলে।
সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সূত্র, স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সাধারণ জনগণের বরাতে জানা গেছে—নিক্সন চৌধুরী তার রাজনৈতিক প্রভাব ও পারিবারিক ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে বিগত এক দশকে অবৈধভাবে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন।
২০১৪ সালের বিনাভোটের নির্বাচনে ফরিদপুর-৪ আসন থেকে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন নিক্সন। তখন তিনি হলফনামায় মোট সম্পদের পরিমাণ দেখিয়েছিলেন প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। তবে ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দাখিল করা হলফনামায় দেখা যায়, তার সম্পদ বেড়ে হয়েছে ৫৪ গুণ। কৃষিজমি বেড়েছে ৩৮ শতাংশ থেকে ২,০৪২ শতাংশে, ঢাকায় বনানী, গুলশান, আদাবর ও পূর্বাচলে একাধিক ফ্ল্যাট ও প্লট যোগ হয়েছে তার মালিকানায়।
ফরিদপুর ও আশপাশের এলাকায় নিক্সন চৌধুরীর নামেই গড়ে উঠেছে বিশাল এস্টেট ‘আইমান আইল্যান্ড’। স্থানীয়দের অভিযোগ, জমির মালিকদের জোর করে বা নামেমাত্র টাকায় জমি লিখে নিতেন তিনি। এমনকি সাবরেজিস্ট্রারকে নিজের বাড়িতে ডেকে নিয়ে জমি রেজিস্ট্রেশনের ঘটনাও ঘটেছে। ফরিদপুরের আওয়ামী রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার ও প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমন করতে তিনি গড়ে তোলেন তথাকথিত “হেলমেট বাহিনী”, যারা তার হয়ে এলাকাজুড়ে দখল, চাঁদাবাজি, মারধর ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করত বলে অভিযোগ রয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, এমপি থাকাকালে নিক্সন চৌধুরী ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রায় ১১ কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেন। পাশাপাশি নিজের ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ৫৫টি ব্যাংক হিসাবে মোট ১,৪০২ কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছে। তার স্ত্রী তারিন হোসেনের বিরুদ্ধেও আলাদা মামলা রয়েছে; তিনি নিজের ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট ১৭টি ব্যাংক হিসাবে ১,৭৬০ কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের সঙ্গে জড়িত বলে দুদকের অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে।
এছাড়া গুলশানে তারিন হোসেনের নামে ক্রয়কৃত ১৩ তলা ভবনের ফ্ল্যাটসহ প্রায় ১০ কোটি টাকার স্থাবর সম্পদের তথ্যও পাওয়া গেছে। তদন্তে উঠে এসেছে, এসব সম্পদ কেনার অর্থের উৎস দেখানো হয়নি।
এদিকে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নিক্সন চৌধুরীর বিরুদ্ধে তিনটি হত্যা মামলাও রয়েছে, যার মধ্যে একটি স্কুলশিক্ষার্থী হত্যার অভিযোগে দায়ের হয়েছে। গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, নিক্সন চৌধুরীর উত্থান এবং তার বিরুদ্ধে এভাবে দুর্নীতি ও অপরাধের পাহাড় গড়ে ওঠা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির এক নির্মম চিত্র তুলে ধরে, যেখানে পারিবারিক প্রভাব ও ক্ষমতার ছায়ায় একজন ব্যক্তির হাতে গড়ে উঠেছে ভয়ংকর এক “স্থানীয় সাম্রাজ্য।”







