জুলাই বিপ্লবের অগ্রনায়ক ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদির ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেছে। গোয়েন্দা সূত্রে আশঙ্কা করা হচ্ছে, এ ধরনের কাপুরুষোচিত হামলা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত হতে পারে। ঘটনার রহস্য উদঘাটনে শনিবার দিনভর মাঠে কাজ করে পুলিশ।
ফেব্রুয়ারির সংসদ নির্বাচন ভণ্ডুল করার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই হাদির ওপর হামলায় দেশবিরোধী শক্তির মদত থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ঘটনার পর জুলাই আন্দোলনের সংশ্লিষ্ট অংশীজন, সম্ভাব্য প্রার্থী ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সন্দেহ, পতিত স্বৈরাচারের দল—কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাট এই হামলার পেছনে জড়িত থাকতে পারেন। জুলাই বিপ্লবের পর তিনি ভারতে পালিয়ে গেছেন। সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ক্যাডার ফয়সাল করিম মাসুদকে শনাক্ত করা হয়েছে। তবে শনিবার রাত পর্যন্ত গুলিবর্ষণে জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।
হামলায় জড়িত দুইজন দেশ ছাড়তে না পারে—এ জন্য দেশের সব বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি সীমান্তে নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) জানিয়েছে, ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দল, গোষ্ঠী ও নেতাদের ভয় দেখাতেই এ হামলা চালানো হয়েছে। ভবিষ্যতে এমন ঘটনা ঠেকাতে ঢাকাসহ সারাদেশে রেকি ও তল্লাশি জোরদার করা হবে। জামিনে থাকা সন্ত্রাসীদের আলাদা তালিকা তৈরির উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে।
ডিবি ও র্যাব মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করছে। কেন, কারা ও কী উদ্দেশ্যে হাদিকে গুলি করা হয়েছে—তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রয়োজনে একাধিক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। শনিবার রাত পর্যন্ত থানায় মামলা হয়নি; তবে প্রক্রিয়াধীন বলে জানিয়েছে পুলিশ।
ঘটনাস্থল ও আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণে মোটরসাইকেলের পেছনে বসে গুলি করা ব্যক্তির চেহারার সঙ্গে ফয়সালের মিল পাওয়া গেছে। তাকেই প্রধান সন্দেহভাজন মনে করছে পুলিশ। এর আগে মোহাম্মদপুরের আদাবরে একটি অফিসে ঢুকে অস্ত্রের মুখে ১৭ লাখ টাকা লুটের ঘটনায় তিনি র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।
শুটার ফয়সালসহ মোটরসাইকেলে থাকা আরেকজনকে ধরতে অভিযান চলছে। ডিবি জানিয়েছে, শনাক্ত ব্যক্তিকে ধরিয়ে দিতে সাধারণ মানুষের সহযোগিতা কামনা করা হচ্ছে।
ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘হাদিকে কারা গুলি করেছে—তা শনাক্তে কাজ চলছে। এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।’ র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এম জেড এম ইন্তেখাব চৌধুরী বলেন, ‘আমরা ছায়া তদন্ত করছি, টিম মাঠে কাজ করছে।’
রেকি করেই হামলা
ডিবির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, হাদিকে টার্গেট করেই হামলা চালানো হয়েছে। শুক্রবার ছুটির দিনে সড়ক ফাঁকা থাকার সুযোগে কিলাররা কানের নিচে গুলি করে দ্রুত পালিয়ে যায়। গুলির ধরন দেখে পরিকল্পিত হামলার ইঙ্গিত মিলেছে। আগে থেকেই রেকি করে সময় ও স্থান নির্ধারণ করা হয়েছিল বলে ধারণা পুলিশের।
সন্দেহের তীর একাধিক দিকে
হামলার ঘটনায় পুলিশের সন্দেহের তালিকায় একাধিক ব্যক্তি রয়েছে; এর মধ্যে সম্রাট অন্যতম। অস্ত্র আইনে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত এই ব্যক্তি বর্তমানে পলাতক। পুলিশের ধারণা, ভোট ভণ্ডুলের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই এ হামলা।
খোয়া যাওয়া অস্ত্র নিয়ে শঙ্কা
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর বিভিন্ন থানা ও পুলিশ স্থাপনা থেকে লুট হওয়া বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদ এখনো পুরোপুরি উদ্ধার হয়নি। এখনো ১,৩৩৬টি অস্ত্র ও ২,৫৭,২৮০টি গোলাবারুদ উদ্ধার বাকি। এসব অবৈধ অস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতে যাওয়ার আশঙ্কায় নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন পুলিশ।
ভোট ভণ্ডুলের আশঙ্কা
ভোটের তারিখ ঘোষণার পরদিনই হাদির ওপর হামলা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ভাবিয়ে তুলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক সহিংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা উল্লেখ করে পুলিশ বলছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অস্থির করাই দুর্বৃত্তদের লক্ষ্য।
দ্রুত গ্রেপ্তারের আশাবাদ
ডিএমপি কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলী বলেছেন, হত্যাচেষ্টায় জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে। তিনি জানান, ‘প্রাইম সাসপেক্টকে খুঁজছি। জনগণের সহযোগিতা চাই।’ সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিয়েও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
মামলা প্রক্রিয়াধীন
গত শুক্রবার দুপুর ২টা ২৫ মিনিটে রাজধানীর বিজয়নগর বক্স কালভার্ট রোডে হাদিকে হত্যাচেষ্টার ঘটনা ঘটে। ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও শনিবার রাত পর্যন্ত মামলা হয়নি। পল্টন থানার এসআই রকিবুল হাসান জানান, মামলার প্রক্রিয়া চলমান।







