আওয়ামী লীগ সরকারের সময় কিছু বেসরকারি ব্যাংকে পরিচালনা পর্ষদের অতিরিক্ত হস্তক্ষেপের অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম উপেক্ষা করে অনেক পরিচালক বেআইনিভাবে সুবিধা গ্রহণ করেছেন, যার ফলে কিছু ব্যাংকের এমডি বা প্রধান নির্বাহী ফেঁসে গিয়েছেন। সরকার পরিবর্তনের পরও এ ধরনের পরিস্থিতি অব্যাহত রয়েছে।
গত সাত-আট মাসে ছয়টি বেসরকারি ব্যাংকের এমডি পদত্যাগ করেছেন। এর মধ্যে চারজনই মাত্র ১৭ দিনের ব্যবধানে পদত্যাগ করেছেন। প্রধানত বোর্ড সদস্যদের অনৈতিক দাবির কারণে তারা দায়িত্ব পালন করতে পারছিলেন না। কেউ কেউ নিরাপত্তার কারণে পদত্যাগ করছেন।
অধিকাংশ এমডি পদত্যাগের পেছনে ব্যক্তিগত কারণ থাকলেও, তারা আশঙ্কা করছেন সত্য ঘটনা প্রকাশ করলে ভবিষ্যতে চাকরিতে সমস্যা হতে পারে। অন্যদিকে, ব্যাংকের পরিচালকরা অভিযোগ করছেন এমডিরা প্রত্যাশিত পারফরম্যান্স দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক এমডি ও বোর্ড সদস্যদের বক্তব্য শুনছে এবং কিছু ক্ষেত্রে তদন্তও করছে।
ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, গত ১০-১৫ বছর ধরে ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনের অভাব রয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে পরিচালনা পর্ষদ যেটা চায় তাই করেছে। এর প্রভাব এখনও দেখা যাচ্ছে। ফলে অনেক এমডি স্বস্তিতে থাকতে পারছেন না এবং বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করছেন।
পদত্যাগ করা এমডিদের মধ্যে রয়েছেন—ঢাকা ব্যাংকের শেখ মোহাম্মদ মারুফ, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের মোশারফ হোসেন, সাউথইস্ট ব্যাংকের নুরুদ্দিন মো. ছাদেক হোসেন, মেঘনা ব্যাংকের কাজী আহ্সান খলিল, ন্যাশনাল ব্যাংকের তৌহিদুল আলম খান এবং ব্র্যাক ব্যাংকের সেলিম আর এফ হোসেন। তাদের মধ্যে প্রথম ছয়জন ২৯ জুলাই থেকে ১৪ আগস্টের মধ্যে পদত্যাগ করেন।
ঢাকা ব্যাংকের এমডি শেখ মোহাম্মদ মারুফ গত ১৪ আগস্ট পদত্যাগ করেন। তিনি জানিয়েছেন, পদত্যাগের পেছনে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত কারণ রয়েছে। ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘আমাদের সঙ্গে কোনো সমস্যা হয়নি, শুধু কিছু নিয়ম পালন করতে ব্যর্থ হয়েছি।’
বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের এমডি মোশারফ হোসেন ৩০ জুলাই পদত্যাগ করেন। জানা যায়, ৪৮ কোটি টাকা সুদ মওকুফের সিদ্ধান্ত ঘিরে বিতর্কের পর বোর্ডের অসৌজন্যমূলক আচরণের কারণে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেন, ‘এমডি পদত্যাগ করেছে কারণ লক্ষ্য পূরণ হয়নি; সুদ মওকুফ কোনো ইস্যু নয়।’
সাউথইস্ট ব্যাংকের এমডি নুরুদ্দিন মো. ছাদেক হোসেন ৩১ জুলাই অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দেন। মেঘনা ব্যাংকের এমডি কাজী আহ্সান খলিল ২৯ জুলাই পদত্যাগ করেন। তিনি বলেন, ‘নতুন বোর্ড আমাকে ছুটিতে পাঠানোর চেষ্টা করেছে, আমি রাজি না হয়ে পদত্যাগ করেছি।’
ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি সেলিম আর এফ হোসেন মে মাসে পদত্যাগ করেন। তিনি বলেন, ‘বোর্ডের অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ ও অনিয়মের কারণে অনেক এমডি বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করেন। এমডির কাজ জটিল, আর আমাদের দেশে সুশাসনের অভাবের কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটে।’
ন্যাশনাল ব্যাংকের এমডি তৌহিদুল আলম খান গত বছরের ডিসেম্বরে পদত্যাগ করেন। ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা খারাপ এবং বেনামি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার চাপ ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র শাহরিয়ার সিদ্দিকী জানিয়েছেন, ‘আগে এমডি ও মালিক একসঙ্গে অনিয়ম করতেন, এখন অনেক এমডি মালিকদের চাপ সহ্য না করে পদত্যাগ করছেন। এই দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই হয়তো সুশাসনের পথ তৈরি হবে।’