শহীদের রক্তের দাগ শুকায়নি। এখনও দেয়ালে দেয়ালে প্রতিবাদের ভাষা। ভবনের প্রাচীরে এখনও গুলির চিহ্ন। বাড়িতে বাড়িতে এখনও আহাজারি, কান্নার রোল। আহত ও পঙ্গুত্ববরণকারী গাজীদের অনেকেই এখনও পুরোপুরি সুস্থতার স্বাদ পায়নি। পুনর্বাসন ও সুচিকিৎসার দাবিতে এখনও মাঝে মধ্যেই আন্দোলন করতে হচ্ছে তাদের। স্বৈরাচারের অস্ত্র ও গুলির মুখে মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে দু’হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে জীবন দিয়ে শহীদ হলো যারা, তাদের রক্তের বদলা নেয়ার আগেই চারদিকে বেঈমানীর প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে গেল! এসব ভাবতে গেলে ঘৃনা, লজ্জা আর অপমানে গা গুলিয়ে ওঠে। ভাবতেই অবাক লাগছে আসলেই কি আমরা মানুষ?
জুলাই বিপ্লব বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন একটি গণঅভ্যুত্থান যা অগণিত প্রাণ বিসর্জন দেয়ার মধ্য দিয়ে খুনী হাসিনার দীর্ঘ ১৬ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটিয়েছে। মানুষকে নতুন করে প্রাণ খুলে কথা বলার স্বাধীনতা এনে দিয়েছে। ডিজিটাল বাকশালের পতন ঘটিয়ে বাস্তবিক অর্থে জনগণের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। একথা দিবালোকের মতই সত্য যে, ছাত্র-জনতার আপোষহীন আন্দোলনের ফলে ৫ আগস্ট খুনী হাসিনা পালিয়ে না যেত তবে গুম, খুন আর অরাজকতার আতঙ্ক নিয়েই আমাদের আজও দিনাতিপাত করতে হতো। যারা শোষণ ও বৈষম্য বিরোধী এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদেরকে ফাঁসিতে ঝোলানোর যাবতীয় বন্দোবস্ত এতদিনে আওয়ামী সরকার নিশ্চিত করতো। অথচ ছাত্র-জনতার ওপর চালানো গণহত্যায় অংশগ্রহণকারী ও নেতৃত্বপ্রদানকারীদের বিচার নিশ্চিত করা গেলনা! পাড়ায় মহল্লায় গণহত্যাকারী সংগঠন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগসহ তাদের অঙ্গসংগঠনের খুনীরা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে অলিগলি থেকে বেরিয়ে ঝটিকা মিছিল করার দুঃসাহস দেখাচ্ছে। অন্যদিকে জুলুম, নিপীড়ন, গণমানুষের কণ্ঠরোধ, গুম, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া খুনী হাসিনা ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা এখনও হম্বিতম্বি করছে দেশে এসে পুনরায় রাজনীতিতে ফেরার জন্য। খায়েশ প্রকাশ করছে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার! সাংবাদিকতার পরিচয়ে জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে অবমাননাকর প্রশ্ন করার দুঃসাহসও দেখাচ্ছে কেউ কেউ। এতবড় নির্মম গণহত্যা চালানোর পরেও হাসিনাকে খুনী বলা যাবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন করার চেষ্টা করছে এসব সাংবাদিক পরিচয়ধারী স্বৈরাচারের দোসররা!
পৃথিবীর ইতিহাসে নিষ্ঠুরতম এই স্বৈরাচারের পতনের পর যেখানে সব রাজনৈতিক দলগুলোকে এক কাতারে দাঁড়িয়ে তাদের অপকর্মের তালিকা ধরে বিচারের আওয়াজ তোলার কথা ছিল। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কাছে বিকিয়ে দেয়ার অপরাধে তাদের ফাঁসির দাবি ওঠার কথা ছিল। অথচ হচ্ছেটা কি? টিভি আর পত্র-পত্রিকা খুললেই যেন নির্বাচন নির্বাচন বলে জিকির শুরু হয়ে যাচ্ছে। পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের আদলে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি আর দখলের মহোৎসব দেখা যাচ্ছে চারদিকে। গুম-খুনের নেশায় আসক্ত আওয়ামী লীগের ‘সাংগঠনিক অপরাধ ও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের’ বিষয়গুলো আমলে নিয়ে দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে রাজপথে নেমে আসার বদলে এই জম্বি সংগঠনের সদস্যদের বিভিন্নভাবে আশ্রয় প্রশ্রয় দেয়ার খবর নিয়মিত ভাইরাল হচ্ছে।
ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ৯ মাস পর দেশ ত্যাগ করেছেন খুনের মামলার আসামী অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ। গণহত্যার মামলার আসামী হয়েও তিনি কীভাবে দেশত্যাগ করতে পারলেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এর মাত্র কয়েক দিন আগে দেশ ছেড়েছেন বিতর্কিত প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক। যিনি অন্যায্য রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়ে এদেশের সুপ্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সঙ্কটে ফেলে দিয়েছিলেন। আর সুযোগ নিয়ে দানবে পরিণত হয়েছিল খুনী হাসিনা ও তার জম্বি বাহিনী।
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করে অবস্থান নিয়েছে ছাত্র-জনতা। বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে শাহবাগে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি। শুক্রবার রাতে হাদি তার ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের বেগম জিয়া, শাহবাগে হাজারো শহীদ পরিবার ও সারাদেশ আপনার অপেক্ষায়।’
জুলাই বিপ্লবের অন্যতম আইকনিক ছাত্রনেতা সারজিস লিখেছেন, ‘বিএনপি এবং তার অঙ্গসংগঠন ব্যতীত সকল রাজনৈতিক দল এখন শাহবাগে। বিএনপি আসলে জুলাইয়ের ঐক্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। ঐক্যবদ্ধ শাহবাগ বিএনপির অপেক্ষায়।’
সারা বাংলাদেশ জেগে আছে। জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে বেঈমানী করছে কারা তা তারা দেখতে চায়। গণহত্যাকারী সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে কে কি ভূমিকা পালন করছে তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে গণতন্ত্র মুক্তিকামী জনগণ। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও স্বকীয়তা রক্ষায় সকলকে এগিয়ে আসতে হবে ঐক্যবদ্ধভাবে। মনে রাখবেন, বেঈমানী করলে ব্যর্থ হবে জুলাই বিপ্লব, ভয়ঙ্কর রূপে ফিরবে খুনে আসক্ত আওয়ামী লীগ। জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার আগে দেখেন যেটা ভালো মনে করেন।
লেখক: সম্পাদক, আজাদির ডাক