রাজনীতির মাঠে প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা এমনকি সংঘর্ষও ছিল। কিন্তু যশোরের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের মধ্যে ব্যক্তিগত সৌহার্দ্য ছিল নজরকাড়া। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ সময় ধরে এখানকার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তরিকুল ইসলাম, খালেদুর রহমান টিটো ও আলী রেজা রাজু। নির্বাচনে তারা একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বীও হয়েছেন। কেউ জিতেছেন, কেউ হেরেছেন, কিন্তু মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত তাদের ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব অটুট থেকেছে।
এই চিত্র বদলে যায় ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর। প্রবীণ নেতৃত্বকে সরিয়ে নতুন প্রজন্মের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে ওঠা নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির কোনো চিহ্নই ছিল না। প্রতিপক্ষের বাড়ি-ঘর ও কার্যালয়ে বোমা হামলা, রাজনৈতিক হত্যা, মিছিল-সমাবেশে আক্রমণ—এসব হয়ে ওঠে নিত্যকার ঘটনা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাংশ রাজনৈতিক ক্যাডারদের সঙ্গে মিলে এই দমন-পীড়নে সরাসরি অংশ নেয়। ফলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের শাসনকে স্থানীয় রাজনীতিকরা আখ্যা দেন “অন্ধকার সময়” হিসেবে।
এই সময়ে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ভেঙে পড়ে, নিপীড়ন-নির্যাতন নতুন রেকর্ড গড়ে। দলীয় সূত্র মতে, এই সময়ে যশোরে বিএনপির ৬৮ নেতাকর্মী খুন হন, অগণিত আহত হন। জামায়াতে ইসলামীর ১০ নেতাকর্মী নিহত হন, আর ছাত্রশিবিরের একজন নেতা এখনো গুম। পুলিশের গুলিতে আহত হন অন্তত ৫৫০ জন, যাদের মধ্যে ৫৫ জন স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যান।
সাড়ে ১৫ বছরে বিএনপি-জামায়াতের হাজারো নেতাকর্মীর ঘরবাড়ি আক্রান্ত হয়। অনেকেই বছরের পর বছর বাড়িতে রাত কাটাতে পারেননি। তাদের নামে অন্তত ২২০০ “গায়েবি” মামলা দেওয়া হয়, আসামির তালিকায় ছিলেন শীর্ষ নেতা থেকে তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীরা। কেউ কেউ ২৫–৩০ বার পর্যন্ত কারাভোগ করেছেন।
যশোরের পাবলিক প্রসিকিউটর সৈয়দ সাবেরুল হক সাবুর হিসাব মতে, এই সময়ে যশোরে ২২০০ রাজনৈতিক মামলা হয়। অধিকাংশই কথিত নাশকতার মামলা, বাদী হয় পুলিশ বা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রয়াত সদস্য তরিকুল ইসলাম কিংবা জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা আজীজুর রহমানের বিরুদ্ধেও মামলা ছিল। অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে শুয়ে থেকেও তরিকুল ইসলামকে আদালতে হাজির হয়ে জামিন চাইতে হয়েছিল, যা ইতিহাসে বিরল নিপীড়নের উদাহরণ।
বিএনপির বর্তমান জেলা সভাপতি সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু ও সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন খোকনসহ মধ্যম পর্যায়ের প্রায় সবার নামেই একাধিক মামলা হয়। জামায়াতের প্রায় প্রতিটি শীর্ষ ও মধ্যম পর্যায়ের নেতার বিরুদ্ধেও মামলা ছিল, যাদের অনেকে বহুবার জেল খেটেছেন।
এই সময়ে রাজনৈতিক হত্যা ও টার্গেট কিলিং ছিল আরেক ভয়ংকর দিক। বিএনপি নেতা নাজমুল ইসলাম ও আবু বকর আবু কিংবা জামায়াত কর্মী হাফেজ মোয়াজ্জেমুল হক (নান্নু হুজুর) নির্মমভাবে খুন হন। অসংখ্য জনপ্রিয় নেতাকে টার্গেট করে সরিয়ে দেওয়া হয়। পরিবারগুলো আজও বিচার পায়নি।
হত্যার শিকার হয়েছেন বিএনপি-জামায়াতের আরও বহু নেতাকর্মী। অনেককে গুম বা ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়, শত শত মানুষ পঙ্গু হয়ে যান। আওয়ামী শাসনামলে বোমা হামলায় বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিরোধী নেতাদের বাড়ি ও কার্যালয়। অভিযোগ করা হলেও পুলিশ মামলা নিত না।
তাছাড়া এসপি আনিসুর রহমানের আমলে “জঙ্গি নাটক” সাজিয়ে বহু নিরীহ মানুষকে হয়রানি করা হয়। তার সময়েই “ফুল ডাউন” (হত্যা) ও “হাফ ডাউন” (অঙ্গহানি) নামে দমননীতি চালু হয়।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যশোরে শহীদ হন অন্তত ২৭ জন। তাদের বেশিরভাগই আওয়ামী ক্যাডারদের আগুনে কিংবা পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান।
সামগ্রিকভাবে, স্থানীয় রাজনীতিকদের ভাষ্যে শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনকাল ছিল যশোরের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে দমন-পীড়নময় অধ্যায়। প্রতিপক্ষকে দুর্বল করতে হত্যা, গুম, মিথ্যা মামলা, কারাবরণ, সম্পদ দখল, অফিস বন্ধ করে দেওয়া—সবই ছিল প্রতিদিনের বাস্তবতা।