‘গুলি করলে একজন মারা যায়, একজন আহত হয়—স্যার, একটিই যায়, বাকিরা যায় না।’
মোবাইলের স্ক্রিনে ভিডিও দেখছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। পাশে বসা অনুগত এক পুলিশ কর্মকর্তা এভাবেই বলছিলেন। চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থান দমনকালে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশদাতা ছিলেন এই কামাল।
কারওয়ান বাজার–তেজগাঁও এলাকায় একসময় মাস্তান হিসেবে পরিচিত কামাল আওয়ামী লীগের এমপি হয়েই হয়ে ওঠেন আরও ভয়ংকর। ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি তিনি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হন। দায়িত্ব নেওয়ার পরদিনই রাজারবাগে সাংবাদিকদের বলেছিলেন—‘বিরোধী দলকে দেখে নেব, কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।’ কথা তিনি রেখেছিলেন। গুম, ক্রসফায়ার, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, অপহরণ, মাদকব্যবসা—এমন কোনো অপকর্ম নেই যেখানে তার সংশ্লিষ্টতা ছিল না।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ নির্দেশেই তিনি কাজ করতেন। সন্ধ্যা নামলেই ধানমন্ডির বাসা থেকে ছুটতেন গণভবনে; সেখান থেকে নির্দেশ নিয়ে মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন করতেন। তার হাত ধরে উঠে এসেছিল কুখ্যাত পুলিশ কর্মকর্তা বেনজীর আহমেদ, প্রলয় কুমার জোয়ার্দ্দার, মোল্লা নজরুল ইসলাম, বিপ্লব বিজয় মজুমদার, ডিবি হারুন ও র্যাবের ব্যারিস্টার হারুনসহ অসংখ্য ‘সন্ত্রাসী কর্মকর্তা’। যারা বিরোধী মত দমনে নির্যাতনে পারদর্শী ছিল, তাদের তিনি পদোন্নতি দিতেন। যোগ্য কর্মকর্তারা থেকে যেতেন উপেক্ষিত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি সিদ্ধান্তে ছিল তার একক কর্তৃত্ব। এজন্যই অনেকে তাকে বলতেন ‘ঠাণ্ডা মাথার খুনি’।
পদোন্নতি ও বদলির নামে কোটি কোটি টাকার ঘুষ লেনদেন করতেন। পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, পাসপোর্ট, আনসার—সবখানে তার দাপট। ঢাকার তেজগাঁও-১১ আসনে তার সন্ত্রাসে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীরা বছরের পর বছর পলাতক জীবন কাটাত। তার স্ত্রীকেও ঘুষের মাধ্যম বানানো হয়েছিল।
২০২৪ সালের ৪ আগস্ট রাতে দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর দিয়ে তিনি ভারতে পালান। বর্তমানে কলকাতার শোভাবাজার এলাকায় তার পুরনো বন্ধু সুবোল চক্রবর্তীর বাড়ির এক কক্ষে তিনি অবস্থান করছেন। কলকাতা পুলিশের তালিকায় শীর্ষ পলাতক আওয়ামী নেতাদের একজন তিনি। মাঝে মাঝে ভারতীয় ঘনিষ্ঠ গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় বক্তব্য দিচ্ছেন।
জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনের প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে—চব্বিশের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান দমনকালে প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগের নেতৃত্বে ছিলেন শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল। ১২ জুলাই অনুষ্ঠিত বৈঠকে কামাল সরাসরি বিজিবিকে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেন। পরদিন হাসিনা বিক্ষোভকারীদের হত্যা ও লাশ গুম করার নির্দেশ দেন—কামাল ছিলেন সেই বৈঠকের অংশ।
পুলিশের সাবেক আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন ট্রাইব্যুনালে স্বীকার করেছেন—প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামালের নির্দেশেই জুলাই গণহত্যা সংঘটিত হয়। ‘লেথাল উইপন’ ব্যবহারের নির্দেশও এসেছিল কামালের মাধ্যমে।
কামাল পুলিশ বাহিনীর ভেতরে গড়ে তোলেন মাফিয়া নেটওয়ার্ক। যোগ্য কর্মকর্তাদের তিনি বঞ্চিত করে নিজের অনুগতদের প্রমোশন দিতেন। বদলি ও পদায়নের বাণিজ্যে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। নাটক সাজানো ‘জঙ্গি অভিযান’, গায়েবি মামলা, বিরোধী নেতাদের গুম—সবই তার পরিকল্পনায়। ছাত্রলীগ–যুবলীগকে তিনি অবাধে অস্ত্রের লাইসেন্স দিয়েছেন—তার সময়ে প্রায় ৩২ হাজার লাইসেন্স দেওয়া হয়। সেই অস্ত্র দিয়ে তৈরি হয়েছিল কুখ্যাত হেলমেট বাহিনী।
ধানমন্ডির ৫ নম্বর সড়কের ২০ নম্বর বাড়ি ছিল তার ষড়যন্ত্রের আখড়া। প্রতিরাতে আইজি, র্যাব, বিজিবি, এসবি কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করতেন। সেখান থেকেই আসত গুম, খুন ও দমন-পীড়নের নির্দেশ।
দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়েছে—তার পরিবারসহ শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের প্রমাণ। এনওসি বাণিজ্য, নিয়োগ-বাণিজ্য, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি—সবখানেই তার সরাসরি সংশ্লিষ্টতা।
সবশেষে, কারওয়ান বাজারে প্রতিদিন দেড় কোটি টাকার চাঁদা উঠত তার হয়ে কাউন্সিলর শামীমের মাধ্যমে। বিরোধী ব্যবসায়ীরা চাঁদা না দিলে দোকান বন্ধ রাখতে বাধ্য হতেন।
সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও রক্তাক্ত দমননীতির জন্য ইতিহাসে আসাদুজ্জামান খান কামাল এখন চিহ্নিত একজন পলাতক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।