প্রতি বছর ৬ অক্টোবর বিশ্বজুড়ে পালিত হয় ‘বিশ্ব সেরেব্রাল পালসি দিবস’ (World Cerebral Palsy Day) । এই দিনটি উদযাপনের মূল উদ্দেশ্য হলো সেরেব্রাল পালসি (Cerebral Palsy বা CP) সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা, আক্রান্ত ব্যক্তিদের অধিকার নিশ্চিত করা এবং সমাজে তাদের পূর্ণ অন্তর্ভুক্তির পথ প্রশস্ত করা।
সেরেব্রাল পালসি (CP) হলো একটি স্নায়ুবিক বিকাশজনিত অবস্থা, যা শিশুর মস্তিষ্কের ক্ষতির কারণে ঘটে। সাধারণত জন্মের আগে, সময়ে বা জন্মের অল্প সময় পর মস্তিষ্কে আঘাত বা বিকাশজনিত সমস্যার কারণে এটি হতে পারে। এর ফলে শরীরের নড়াচড়া, পেশীর নিয়ন্ত্রণ, ভারসাম্য এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যবহারের ক্ষমতা প্রভাবিত হয়।
সহজভাবে বলা যায়, সেরেব্রাল পালসি এমন এক অবস্থা, যা শিশুর চলাফেরা, কথা বলা, খাওয়া, শেখা ও দৈনন্দিন কাজের দক্ষতা সীমাবদ্ধ করে দিতে পারে।
- বিশ্বজুড়ে প্রতি ৪০০ শিশুর মধ্যে প্রায় ১ জন সেরেব্রাল পালসিতে আক্রান্ত।
- এটি জন্মগত বা জীবনের প্রথম পর্যায়ে ঘটে, কিন্তু এর প্রভাব সারাজীবন থাকে।
- চিকিৎসা সম্পূর্ণ না হলেও, থেরাপি, শিক্ষা, এবং সহায়তামূলক প্রযুক্তির মাধ্যমে আক্রান্ত ব্যক্তির জীবনমান উন্নত করা সম্ভব।
প্রতি বছর দিবসটির জন্য একটি নির্দিষ্ট থিম নির্ধারণ করা হয়, যার মাধ্যমে জনসচেতনতা এবং ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়। মূল বার্তা সবসময় একটাই – “একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তুলি, যেখানে সেরেব্রাল পালসিতে আক্রান্ত প্রতিটি মানুষ সমানভাবে বাঁচতে, শিখতে ও কাজ করতে পারে।”
বিশ্ব সেরেব্রাল পালসি দিবস প্রথম শুরু হয় ২০১২ সালে, যখন বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা, সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবকরা একত্র হয়ে সেরেব্রাল পালসি আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য একটি বৈশ্বিক আন্দোলন গড়ে তোলে। এই দিনের প্রধান লক্ষ্য হলো:
- সেরেব্রাল পালসি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
- আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রতি সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ও সহানুভূতি বাড়ানো।
- তাদের জন্য শিক্ষার, চিকিৎসার ও কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করা।
- সরকার ও নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো।
চিকিৎসা ও পুনর্বাসনঃ
যদিও সেরেব্রাল পালসির কোনো স্থায়ী চিকিৎসা নেই, তবে যথাযথ চিকিৎসা ও থেরাপির মাধ্যমে আক্রান্ত শিশুদের জীবনমান অনেক উন্নত করা যায়। এর মধ্যে রয়েছে:
- ফিজিওথেরাপি: পেশী শক্তিশালী করা ও চলাফেরার উন্নতি।
- অকুপেশনাল থেরাপি: দৈনন্দিন কাজকর্মে স্বাধীনতা অর্জনে সহায়তা।
- স্পিচ এন্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপি: কথা বলা, ভাষা বোঝা ও যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধি।
- ওষুধ বা সার্জারি: খিঁচুনি নিয়ন্ত্রণ বা পেশী শক্ত হওয়া কমাতে।
- শিক্ষা ও পুনর্বাসন: বিশেষ শিক্ষা ও সহায়ক প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষা ও সামাজিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
সমাজের দায়িত্ব ও ভূমিকাঃ
সেরেব্রাল পালসি আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করাই এই দিবসের অন্যতম উদ্দেশ্য।
সমাজের প্রতিটি স্তরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:
- বিদ্যালয়ে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা।
- পরিবারগুলোকে সহায়তা ও মানসিক শক্তি প্রদান।
- কর্মক্ষেত্রে তাদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা।
- সেরেব্রাল পালসি সম্পর্কে নিজে জানা ও অন্যকে জানাতে সাহায্য করা।
- নেতিবাচক মনোভাব ও বৈষম্য দূর করে সমান অধিকার নিশ্চিত করা।
- থেরাপি ও পুনর্বাসন সেবার উন্নয়নের দাবিতে সক্রিয় হওয়া।
বাংলাদেশে হাজার হাজার শিশু সেরেব্রাল পালসিতে আক্রান্ত হলেও অনেকেই সঠিক নির্ণয়, চিকিৎসা ও থেরাপি পায় না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা যেমন সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড (CRP), ও BRAC ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখছে। তবে এখনো পর্যাপ্ত সেবা, থেরাপিস্ট ও সচেতনতার অভাব রয়েছে। এ অবস্থায় আক্রান্ত শিশু ও তাদের পরিবারকে সহায়তা করতে সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের নীতি, পরিকল্পনা ও বাস্তব পদক্ষেপ সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে সেরেব্রাল পালসি আক্রান্ত ব্যক্তিরা সমাজে মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকতে এবং তাদের সম্ভাবনা অনুযায়ী বিকশিত হতে পারে।
সরকারের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন –
১। স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিতকরণ
সেরেব্রাল পালসির প্রাথমিক শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এজন্য সরকারকে:
- সরকারি হাসপাতাল ও কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রাথমিক স্ক্রিনিং ও নির্ণয় সেবা চালু করতে হবে।
- বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, ফিজিওথেরাপিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট ও স্পিচ থেরাপিস্ট নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
- খরচবহুল চিকিৎসা ও থেরাপি সুবিধা বিনামূল্যে বা কম খরচে প্রদান করতে হবে।
২। শিক্ষা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থার বিকাশ
সেরেব্রাল পালসি আক্রান্ত শিশুরা সাধারণ শিক্ষার সুযোগ থেকে অনেক সময় বঞ্চিত হয়। সরকার এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে:
- ইনক্লুসিভ এডুকেশন (Inclusive Education) নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী শিশুদের সাধারণ বিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
- স্কুলে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ ও সহায়ক প্রযুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
- শিক্ষার সামগ্রী, পরিবহন ও স্কুল অবকাঠামো প্রতিবন্ধীবান্ধব করতে হবে।
- বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও রিসোর্স সেন্টার স্থাপন করে সহায়তা দিতে হবে।
৩। আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন
সেরেব্রাল পালসি আক্রান্ত ব্যক্তিদের অধিকার রক্ষায় আইনি কাঠামো থাকা অত্যন্ত জরুরি। এজন্য সরকারকে:
- প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সংরক্ষণে কার্যকর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
- কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় বৈষম্য রোধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
- প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা ও সংরক্ষিত আসন নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে “প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩” পাস করেছে, যা প্রতিবন্ধীদের অধিকার নিশ্চিত করার একটি বড় পদক্ষেপ। তবে এর কার্যকর বাস্তবায়ন আরও জোরদার করতে হবে।
সেরেব্রাল পালসি কোনো অভিশাপ নয়; এটি একটি অবস্থা যা উপলব্ধি ও সহমর্মিতার মাধ্যমে মোকাবিলা করা যায়। সমাজের প্রতিটি মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সচেতনতাই পারে আক্রান্ত শিশু ও ব্যক্তিদের জন্য একটি মর্যাদাপূর্ণ, স্বনির্ভর ও সম্মানজনক জীবন নিশ্চিত করতে। এই দিন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, প্রতিটি শিশু — তার শারীরিক বা মানসিক অবস্থা যাই হোক না কেন — শিক্ষা, ভালোবাসা, সম্মান ও সুযোগ পাওয়ার পূর্ণ অধিকার রাখে।
আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত একটি এমন সমাজ গড়ে তোলা যেখানে সেরেব্রাল পালসি আক্রান্ত শিশুরা প্রতিবন্ধী নয়, বরং সক্ষম, সম্ভাবনাময় এবং সমাজের মূল্যবান সদস্য হিসেবে বিকশিত হতে পারে। ৬ অক্টোবর, আসুন আমরা সবাই প্রতিজ্ঞা করি — “ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও সমান অধিকারের মাধ্যমে সেরেব্রাল পালসিতে আক্রান্ত প্রতিটি মানুষের পাশে থাকবো।”
লেখক:
মোঃ তানভীর হাসান
লেকচারার, স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি বিভাগ
ময়মনসিংহ কলেজ অব ফিজিওথেরাপি এন্ড হেলথ সায়েন্সেস







