রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকায় খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক কারবার, জমি–ফ্ল্যাট দখল, অস্ত্রের মহড়া ও গণপিটুনির নামে হত্যাকাণ্ডসহ নানা অপরাধে দীর্ঘদিন ধরেই অস্থিরতা চলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র বলছে, এই দুই এলাকায় সক্রিয় রয়েছে অন্তত ১৭টি সন্ত্রাসী গ্রুপ, যাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ১৭ জন ব্যক্তি। এই নেতারা আবার দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী — পিচ্চি হেলাল ও ইমন — এর নির্দেশে পুরো নেটওয়ার্ক পরিচালনা করছেন।
অপরাধের রাজত্বে মোহাম্মদপুর–আদাবর
পুলিশ, র্যাব ও যৌথ বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, এই ১৭ জনের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই রয়েছে ৫ থেকে ৩০টি পর্যন্ত মামলা। এদের মধ্যে দুজন বর্তমানে কারাগারে থাকলেও বাকিরা আত্মগোপনে রয়েছেন। গত বছরের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর সংগঠনের পক্ষ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন তাঁদের মধ্যে চারজন।
এলাকাবাসী বলছেন, অপরাধীদের দৌরাত্ম্যে তাঁরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। দিনে–রাতে ৮–৯টি পর্যন্ত ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে, কিন্তু ভুক্তভোগীদের অনেকেই মামলা করতে ভয় পান। গত ১৩ মাসে খুন হয়েছেন অন্তত ১৮ জন। এর মধ্যে মাদক কারবারের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে জেনেভা ক্যাম্পে একাই নিহত হয়েছেন আটজন।
দেড় মিনিটে ছিনতাই, কেউ এগিয়ে আসে না
বছিলার স্বপ্নধারা হাউজিংয়ের বাসিন্দা শিরিন বেগম জানান, ১ অক্টোবর বিকেলে মায়ের সঙ্গে রায়েরবাজার বেড়িবাঁধ দিয়ে ফেরার পথে কয়েকজন তরুণ দেড় মিনিটের মধ্যে তাঁদের কাছ থেকে টাকা ও গয়না ছিনিয়ে নেয়। আশপাশে মানুষ থাকলেও কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। পুলিশে মামলা করলেও এখনো কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।
তদন্তে জানা গেছে, এই ছিনতাইয়ের পেছনে কারাগারে থাকা সন্ত্রাসী এজাজ ওরফে হেজাজের অনুসারীরা রয়েছে, যিনি ইমনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণ ও চাঁদাবাজির একাধিক মামলা রয়েছে।
বেড়িবাঁধজুড়ে ছিনতাই
গাবতলী স্লুইসগেট থেকে হাজারীবাগ পর্যন্ত বেড়িবাঁধ ও আশপাশের এলাকাজুড়ে ছিনতাইয়ের নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে পড়েছে। সুনিবিড়, তুরাগ, নবীনগর, চাঁদ উদ্যান, স্বপ্নধারা ও চন্দ্রিমা মডেল টাউনসহ অন্তত ৮টি নতুন হাউজিং এলাকায় প্রতিদিনই ছোট–বড় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। এসব এলাকায় পুলিশের উপস্থিতি কম এবং অপরাধীরা কয়েক মিনিটেই পালিয়ে যায়।
আধিপত্যের লড়াই ও ‘গণপিটুনির’ নামে হত্যা
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যে দেখা গেছে, মাদক কারবারের আধিপত্য নিয়ে ১৩ মাসে ১৮টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। শুধু জেনেভা ক্যাম্পেই গত ৯ মাসে ১৯ বার সংঘর্ষ হয়েছে, যাতে আটজন নিহত হয়েছেন।
এ ছাড়া “গণপিটুনির” নামে অন্তত ছয়জনকে হত্যা করা হয়েছে, যা আসলে পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে তদন্তে বেরিয়েছে। যেমন ১৫ মে মোহাম্মদপুরে রাকিব ও মিলন নামের দুই তরুণকে ছিনতাইকারী আখ্যা দিয়ে পেটানো হয়; রাকিব ঘটনাস্থলেই মারা যান।
টহল দলের নামেও ভয়
বাড়ির মালিকদের উদ্যোগে স্থানীয়ভাবে গঠিত রাতের টহল দলগুলোও এখন আতঙ্কের কারণ। নবীনগর হাউজিংয়ের টহল দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে মারধর, আটক ও এমনকি ছিনতাইয়ে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, বিএনপির স্থানীয় এক নেতার নেতৃত্বে গঠিত টহল দলটি কখনও কখনও অপরাধীদের আশ্রয় দেয়।
চাঁদা না দিলে গুলি
গত ২৪ মার্চ শের শাহ সুরি রোডে এক আবাসন ব্যবসায়ীর অফিসে গুলি চালানো হয় চাঁদা না দেওয়ায়। পরে ডিবি ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানে দুজন গ্রেপ্তার হয়। তদন্তে বেরিয়ে আসে, এই ঘটনার পেছনে ছিলেন যুবদলের বহিষ্কৃত এক নেতা, যিনি শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলালের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
পুলিশের দাবি
পুলিশের দাবি, এখন অপরাধের মাত্রা আগের চেয়ে কমেছে। আগে যেখানে প্রতি মাসে ২৫০টি মামলা হতো, এখন তা নেমে এসেছে ১৫০–এর নিচে। তবে কর্মকর্তারা স্বীকার করছেন, গ্রেপ্তারের পর অপরাধীরা জামিনে বেরিয়ে এসে আবার অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. ইবনে মিজান বলেন, “মোহাম্মদপুর বড় এলাকা। এখানে জেনেভা ক্যাম্প ও বস্তি থাকার কারণে অপরাধপ্রবণতা কিছুটা বেশি। তবে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছি, অপরাধের গ্রাফ এখন নিচের দিকে।”
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা মনে করেন, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তভাবে অভিযান পরিচালনা ও নিয়মিত নজরদারি ছাড়া মোহাম্মদপুর ও আদাবরের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।







