আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নারী ভোটারদের ঘিরে বড় কৌশল নিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির মহিলা বিভাগ এখন প্রকাশ্যে মানববন্ধন, সভা-সেমিনার, উঠান বৈঠক ও বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে তাদের সাংগঠনিক শক্তি ও রাজনৈতিক অবস্থান তুলে ধরছে। বিশ্লেষকদের মতে, তৃণমূল পর্যায়ে বিস্তৃত এই মহিলা বিভাগই আগামী নির্বাচনে জামায়াতের জন্য ‘গেম চেঞ্জার’ হয়ে উঠতে পারে।
জামায়াতের নেতারা জানিয়েছেন, মহিলা বিভাগ রুকন সম্মেলন, কর্মী সম্মেলন ও ভোটার সমাবেশসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সাংগঠনিক কার্যক্রমের পাশাপাশি নির্বাচনের প্রস্তুতিও চলছে। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নারী ভোটারদের সমর্থন পেতে মহিলা বিভাগকে ‘ভোটব্যাংক’ হিসেবে শক্ত করতে কাজ করছে জামায়াতে ইসলামী।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময় হামলা, মামলা ও নির্যাতনের মধ্যেও মহিলা বিভাগ গোপনে তাদের দাওয়াতি কার্যক্রম চালু রেখেছিল। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে তারা প্রকাশ্যে মাঠে নেমে আসে। বিভিন্ন সামাজিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে মানববন্ধন আয়োজন করে তারা আলোচনায় আসে। ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিবাদে ও শিশু আছিয়া হত্যার ঘটনায় তারা রাজধানীতে কর্মসূচি পালন করে।
এ ছাড়া তারা ধারাবাহিকভাবে বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছে। গত মে মাসে মহিলা বিভাগের একটি প্রতিনিধি দল ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুকের সঙ্গে বৈঠক করে। এরপর জুলাইয়ে মার্কিন দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন মহিলা বিভাগের নেত্রীরা।

জামায়াতের মহিলা বিভাগের লোকবল এখন সংগঠনের এক বড় শক্তি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। দলীয় সূত্র অনুযায়ী, মোট কর্মীসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশই নারী। অর্ধ লাখ রুকন, প্রায় চার লাখ কর্মী এবং অসংখ্য সহযোগী সদস্য নিয়ে এই বিভাগ দেশের প্রতিটি স্তরে সক্রিয়।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জামায়াতের নারী নেত্রীরা উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। দলীয় তথ্যমতে, ২০১৪ সালের উপজেলা নির্বাচনে মহিলা বিভাগ থেকে ৩৬ জন, ২০০৯ সালে ১২ জন নির্বাচিত হন। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনেও অতীতে জামায়াতের একাধিক নারী সংসদ সদস্য ছিলেন।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম বলেন, “জামায়াতের মহিলা বিভাগে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ রয়েছে—ডাক্তার, শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়ার থেকে গৃহিণী পর্যন্ত। আগামী নির্বাচনে তাদের সক্রিয় ভূমিকা থাকবে।”

তিনি আরও বলেন, “গ্রামে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তারা নারীদের সঙ্গে কথা বলছেন, ভোটার তালিকায় নাম তুলছেন এবং ভোট দেওয়ার বিষয়ে সচেতন করছেন। এখন মহিলা বিভাগের প্রধান কাজই নির্বাচনী প্রস্তুতি।”
মহিলা বিভাগের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি নূরুন্নিসা সিদ্দীকা জানান, “আমরা কেবল ভোটের জন্য কাজ করি না, বরং নারীদের ইসলামী মূল্যবোধে গড়ে তোলার চেষ্টা করি। তবে ভোটের সময় নারীদের সচেতন করে ভোটকে আমানত হিসেবে দেওয়ার আহ্বান জানাই।”
তিনি বলেন, “নারীদের ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার অনীহা কাটাতে আমরা কাজ করছি। ভোটার তালিকায় নাম তুলতে উৎসাহ দিচ্ছি। নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত হলে নারীদের উপস্থিতি আরও বাড়বে।”
নারীবিদ্বেষী দল হিসেবে জামায়াতকে যে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়, তা ‘ভিত্তিহীন’ বলে দাবি করেন মাওলানা হালিম। তিনি বলেন, “আমাদের মোট কর্মীশক্তির প্রায় অর্ধেক নারী। কয়েক বছরের মধ্যে মহিলা বিভাগের রুকন সংখ্যা পুরুষদের চেয়েও বেশি হবে।”

আগামী নির্বাচনে জামায়াতের মহিলা বিভাগ থেকে প্রার্থী দেওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেননি দলটির নেতারা। জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের জানিয়েছেন, দলটি সংরক্ষিত নারী আসন ৫০ থেকে ১০০-তে বৃদ্ধির পক্ষে মত দিয়েছে।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের এক সদস্য জানান, ভবিষ্যতে নারী, সংখ্যালঘু ও রুকন নন—এমন প্রার্থীদেরও মনোনয়ন দেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে। আগে শুধুমাত্র রুকনদের প্রার্থী হওয়ার সুযোগ ছিল, কিন্তু এখন নেতৃত্ব আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জামায়াতের মহিলা বিভাগে কয়েক লাখ সক্রিয় কর্মীর উপস্থিতি দলটির জন্য একটি বড় শক্তি। সংগঠিত নারী ভোটব্যাংক যে কোনো নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় এই কর্মীরা মাঠপর্যায়ে প্রচারে গেলে বড় প্রভাব ফেলতে সক্ষম।
একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, “জামায়াতের এই অর্গানাইজড মহিলা কর্মী বাহিনী নির্বাচনে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। তারা এখন তাদের রাজনৈতিক ভিত্তি ধরে রাখার কৌশল করছে। সাম্প্রতিক ছাত্র নির্বাচনগুলোতে জামায়াতপন্থী সংগঠনের সাফল্যও তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে।”







