অতীতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জোট গঠন ও আসন সমঝোতার জোর প্রস্তুতি দেখা গেলেও, অভ্যুত্থান–পরবর্তী নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় এবার চিত্রটা ভিন্ন। প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী এবার জোট নয়, বরং আসন সমঝোতাকেই বেছে নিয়েছে। ফলে সম্ভাব্য তৃতীয় রাজনৈতিক বলয় গঠনের উদ্যোগও গতি হারিয়েছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নেতৃত্বাধীন এই নতুন জোটে যোগ দিতে চাওয়া ছোট দলগুলো এখন বড় দলগুলোর টিকিটের অপেক্ষায়। ফলে এনসিপি নিজস্ব কৌশলে সংসদে সংস্কারপন্থি ও বিপ্লবীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে চায়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, অতীতের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতৃত্বে দুটি বড় জোট গঠিত হয়েছিল— বিএনপির চারদলীয় জোট এবং আওয়ামী লীগের ১৪ দলীয় জোট। কিন্তু গত বছরের ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ হয়, ফলে ১৪ দল ভেঙে পড়ে এবং জাতীয় পার্টিও কার্যত অন্তরালে চলে যায়। এই শূন্যতায় বিএনপি–জামায়াত এখন আলাদা বলয়ে অবস্থান করছে, যদিও তারা একসময় ছিল মিত্র।
নতুন শক্তি হিসেবে এনসিপি
জুলাই অভ্যুত্থানের পর গঠিত তরুণ নেতৃত্বের দল এনসিপি নিজেদের ‘তৃতীয় শক্তি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। তারা সংসদে সংস্কার-রাজনীতির নতুন বার্তা দিতে আগ্রহী। তবে আলোচনা চললেও এখনো কোনো জোটে যুক্ত হতে পারেনি তারা— প্রধানত বিএনপি ও জামায়াতের প্রভাববলয়ের বাইরে বেশিরভাগ ছোট দল যেতে চায় না।
২০২২ সালে ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’ নামে ছয় দলের জোট গঠিত হয়েছিল— জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন ও ভাসানী জনশক্তি পার্টি। পরে এদের সঙ্গে এনসিপি ও এবি পার্টি যুক্ত হয়ে তৃতীয় জোট গঠনের আলোচনা শুরু করে।
তবে সাম্প্রতিক এক মাসে উদ্যোগ বাড়লেও বিএনপি–জামায়াতের টানাপোড়েন এর পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সূত্রে জানা গেছে, গণতন্ত্র মঞ্চভুক্ত বেশ কিছু দল আসন সমঝোতা নিয়ে বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত, এমনকি প্রার্থী তালিকাও প্রকাশ করেছে কিছু দল।
এনসিপির অবস্থান ও কৌশল
সূত্র বলছে, এনসিপি ‘জুলাই বিপ্লবের’ নেতৃত্বধারী তরুণদের সংসদে পাঠাতে চায়। তারা বিএনপি–জামায়াতকে অনুরোধ করেছে প্রার্থী বাছাইয়ে এ বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে। তবে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
বুধবার এক বিবৃতিতে এনসিপি জানায়, তারা এখনো কোনো জোট বা আসন সমঝোতায় অংশ নেয়নি। নিবন্ধন ও প্রতীক বরাদ্দ বিলম্বে তাদের প্রার্থী ঘোষণাও পিছিয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, এলাকায় জনপ্রিয় ব্যক্তি, বিএনপি বা অন্য দলের মনোনয়নবঞ্চিত নেতাদের ‘শাপলা কলি’ প্রতীকে প্রার্থী করা হবে।
সূত্র জানায়, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ এক সপ্তাহের মধ্যে জারি হলে প্রার্থী তালিকাও প্রকাশ করা হবে। এনসিপি বলছে, তৃতীয় জোট হলে সমন্বিত তালিকা, না হলে একক প্রার্থী ঘোষণা করবে তারা।
নিবন্ধন ও প্রতীক
বহু জটিলতা পেরিয়ে নির্বাচন কমিশন সম্প্রতি এনসিপিকে ‘শাপলা কলি’ প্রতীক বরাদ্দ দিয়েছে। এরপরই আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ঘোষণা দেন, “কোনো জোট নয়, ৩০০ আসনেই শাপলা কলি প্রতীকে লড়বে এনসিপি।”
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর নেতৃত্বে ১০ সদস্যের কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটিও গঠন করা হয়।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, এনসিপি ঢাকার ১২টিসহ অন্তত ৫০টি আসনে জেতার মতো প্রার্থী দিতে চায়। প্রায় ১৫০ আসনের প্রাথমিক তালিকাও তৈরি হয়েছে, যার মধ্যে ১৫–২০ জন হবেন বাইরের পরিচিত মুখ।
সনদ বাস্তবায়ন ও নতুন ঐকমত্যের প্রচেষ্টা
সরকার জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সময় বেঁধে দিয়েছে। বিএনপি প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পর নয় দলের বৈঠকে সনদ বাস্তবায়ন ও সংবিধান সংস্কার নিয়ে ঐক্যমত্যে পৌঁছানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
গণঅধিকার পরিষদের মুখপাত্র ফারুক হাসান বলেন,
“আমরা অনেক দিন ধরেই বিএনপি–জামায়াতের বাইরে নতুন শক্তি গঠনের চেষ্টা করছি। জনগণও নতুন শক্তির উদ্ভব চায়।”
রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সভাপতি হাসনাত কাইয়ুম জানান,
> “সরকার যে সময় দিয়েছে, তার মধ্যেই আমরা জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্যে পৌঁছাতে আলোচনা করছি।”
এনসিপির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
নারায়ণগঞ্জে এক প্রশ্নের জবাবে এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন,
> “জোট বা সমঝোতা আদর্শিক জায়গা থেকে হতে পারে। যদি সে রকম পরিস্থিতি তৈরি হয়, আমরা বিবেচনা করব।”
তবে তিনি পরিষ্কার করেন,
> “আমাদের লক্ষ্য ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়া। ১৫ নভেম্বরের মধ্যেই প্রাথমিক প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হবে।”
সবশেষ বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, “সংস্কার বাস্তবায়নে একমত হলে বিএনপি বা জামায়াতের সঙ্গে জোট সম্ভব, কিন্তু সংস্কার ও বিচার ইস্যুতে সমাধান না এলে আমরা কারও সঙ্গে যাব না।







