আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে রাজধানীজুড়ে এখন উৎসবের আমেজ। চায়ের টং থেকে শুরু করে অফিসের করিডোর, বাসা-বাড়ি থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম—সর্বত্র এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু একটাই বিষয়: ভোট। প্রায় দুই দশক পর এমন স্বাধীন নির্বাচনি পরিবেশে সাধারণ মানুষ যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। শহরের রাস্তাঘাট, মোড়, ও ভবনজুড়ে টাঙানো রঙিন ব্যানার-ফেস্টুন ও হাস্যোজ্জ্বল প্রার্থীদের পোস্টার এখন রাজধানীর নতুন সাজ।
স্বাধীন নির্বাচনের উচ্ছ্বাস
অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষণা দিয়েছে, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ২০০১ সালের পর এটিই প্রথম নির্বাচন, যা নিয়ে জনগণের মধ্যে উৎসবের আমেজ স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। ২০০৮ সালের ‘প্যাকেজ ডিল’, ২০১৪ সালের ‘অটোপাস’, ২০১৮ সালের ‘রাতের ভোট’ এবং ২০২৪ সালের ‘আমি বনাম ডামি’ নির্বাচনের অভিজ্ঞতা পেরিয়ে এখন মানুষ আবার নিজের ভোটাধিকার ফিরে পাওয়ার আনন্দে উচ্ছ্বসিত।
এক তরুণ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী রমজান আহমেদ বললেন, “আমাদের প্রজন্ম আসলে কখনো ভোট দিতে পারেনি। এবার মনে হচ্ছে সত্যিই আমরা নিজেরাই ঠিক করব, কাকে সংসদে পাঠাব।”
প্রার্থীদের ব্যস্ত সময়
ইতোমধ্যে বিএনপি দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্তদের তালিকা প্রকাশ করেছে। জামায়াতে ইসলাম ও আরও কয়েকটি দলও প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যালয়, যা একসময় ফ্যাসিবাদী আমলে ছিল নিস্তব্ধ, এখন সেখানে ভিড় জমেছে কর্মী ও সমর্থকদের।
পল্টন, মিরপুর, বিজয়নগর, গুলশান—সব জায়গায়ই প্রচারণার উৎসব চলছে। কেউ মাঠে-ময়দানে, কেউ আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যস্ত নিজেদের প্রার্থী ও দলের পক্ষে প্রচারে।
জনগণের প্রত্যাশা
রাজধানীর বাইরেও লেগেছে নির্বাচনি উত্তাপ। গ্রাম থেকে শহর, উঠান বৈঠক থেকে পথসভা—সব জায়গায় চলছে ভোটের আলাপ। কেউ প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন দুর্নীতিমুক্ত শাসনের, কেউ বলছেন নতুন সংবিধান ও রাজনৈতিক সংস্কারের কথা।
বিমানবন্দর এলাকার গৃহবধূ সোনিয়া বেগম বলেন, “গত দুই দশকে ভোট বলতে ভয়ই পেয়েছি। এবার মনে হচ্ছে সত্যিই নিরাপদভাবে ভোট দিতে পারব।”
তবে সবাই সমান আশাবাদী নয়। মিরপুরের তরুণ ভোটার মেহেদি হাসান আবদুল্লাহ বললেন, “উৎসবের আবহ ভালো লাগছে, কিন্তু ভোটের দিনটা শেষ পর্যন্ত কেমন যাবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।”
তরুণদের উচ্ছ্বাস
তরুণ ভোটাররাই এবার নির্বাচনের সবচেয়ে বড় শক্তি। তারা শুধু মাঠে নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সরব। পছন্দের প্রার্থীকে নিয়ে বানাচ্ছেন ভিডিও, দিচ্ছেন পোস্ট।
স্লোগান চলছে—“আমার ভোট, আমার অধিকার”, “যাকে খুশি তাকে ভোট”, “জীবনের প্রথম ভোট”—এসব বার্তা ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র।
বিশেষজ্ঞদের মত
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক মো. তৌফিকুর রহমান বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে শেষ কবে এমন নির্বাচনি আমেজে ছিল, তা মনে পড়ে না। ২০০৮ সালের নির্বাচনেও এমন প্রাণচাঞ্চল্য দেখা যায়নি।”
অন্যদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক (অব.) ড. আবদুল লতিফ মাসুম মনে করেন, “রাজধানীর এই নির্বাচনি আমেজ শুধু শহরের সাজ নয়, এটি মানুষের মানসিক জাগরণও। দীর্ঘদিন পর মানুষ আবার ভোটের মূল্য বুঝতে শুরু করেছে, রাজনীতি নিয়ে কথা বলছে—যা গণতন্ত্রের মূল প্রাণ।”
তিনি আরও বলেন, “২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের বিকৃত নির্বাচনের পর এবার মানুষ সত্যিকার অর্থে নিজের ভোটাধিকার ফিরে পেয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার যদি এই পরিবেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে পারে, তবে সেটিই হবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের নতুন সূচনা।”







