পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ১৬ বছর পর অবশেষে স্বাধীন তদন্ত কমিশন সামনে এনেছে সেই ভয়াবহ ঘটনার নেপথ্যের চাঞ্চল্যকর তথ্য। রোববার প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেওয়া ৪০০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বহু অজানা ও স্পর্শকাতর বিবরণ—কারা ছিলেন নির্দেশদাতা, কারা জানতেন অথচ কোনো ব্যবস্থা নেননি, কেন এত বছর সত্য আড়ালে ছিল—সবই সেখানে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
বিশ্বস্ত সূত্রের বরাতে জানা গেছে, ওই প্রতিবেদনে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতা, সাবেক সেনা কর্মকর্তা, গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য, পুলিশ, র্যাব, বিডিআর এবং কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মীসহ অর্ধশতাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম এসেছে।
সূত্রগুলো বলছে, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা ও গোয়েন্দা ব্যর্থতার জটিল সমন্বয়ে কীভাবে রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হতে পারে—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে কমিশন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে সরাসরি অভিযুক্ত করেছে।
রাজনৈতিক পর্যায়ের অভিযোগ
প্রতিবেদনে রাজনৈতিক অভিযুক্তদের শীর্ষে আছেন—
শেখ হাসিনা
ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস
শেখ ফজলুল করিম সেলিম
জাহাঙ্গীর কবির নানক
মির্জা আজম
মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম
ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল
মাহবুব আরা গিনি
প্রয়াত মতিয়া চৌধুরী
আসাদুজ্জামান নূর
এবং আরও কয়েকজন।
প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে—এই হত্যাযজ্ঞে সরাসরি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘গ্রিন সিগন্যাল’ ছিল, আর দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক হিসাব ও ভারতীয় স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যেই তিনি এ ঘটনায় সায় দিয়েছিলেন।
ফজলে নূর তাপসকে ঘটনায় প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তিনি বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছেন।
জাহাঙ্গীর কবির নানক ও মির্জা আজম সম্পর্কে প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে—তারা সাদা পতাকা নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেছিলেন এবং পরে ঘটনার সত্য গোপন করেন। তাদের বিরুদ্ধে লাশ গুম, অস্ত্র সমর্পণে প্রহসন, হত্যাকারীদের পালাতে সহায়তাসহ মোট ১৩টি অভিযোগ আনা হয়েছে।
সেনা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ভূমিকা
প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে কয়েকজন সাবেক সেনা কর্মকর্তার নাম, তাদের মধ্যে আছেন—
জেনারেল মইন ইউ আহমেদ, ভাইস অ্যাডমিরাল জহির উদ্দীন আহমেদ, এয়ার মার্শাল এসএম জিয়াউর রহমান, লেফটেন্যান্ট জেনারেল সিনা ইবনে জামালী, জেনারেল আজিজ আহমেদ, লেফটেন্যান্ট জেনারেল মইনুল ইসলাম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল হাকিম আজিজসহ অনেকে।
তাদের বিরুদ্ধে চেইন অব কমান্ড ভাঙা, উদ্ধার অভিযান বিলম্বিত করা, বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগাযোগ, মিথ্যা সাক্ষ্য, সেনা কর্মকর্তাদের ফাঁসানোসহ একাধিক অভিযোগ আনা হয়েছে।
একইসঙ্গে অন্তত তিনজন মিডিয়াকর্মীর নামও এসেছে তদন্ত।
ঘটনার সময়কার সিদ্ধান্তহীনতা ও বিলম্ব
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে—
বিদ্রোহ শুরুর পর ডিআইজি বিডিআর মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ সরাসরি শেখ হাসিনাকে ফোন করে উদ্ধার অভিযান পরিচালনার অনুমতি চাইলে তিনি প্রথমে সৈন্য পাঠানোর ইঙ্গিত দিলেও দ্রুত কোনো নির্দেশ দেননি। এই বিলম্বই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ করে তোলে।
২০০৯ সালের সেনা তদন্ত কমিটি ও জাতীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন সম্পর্কে কমিশনের বক্তব্য—সেগুলো ছিল ‘দায়সারা’ ও অসম্পূর্ণ।
প্রতিবেদন প্রকাশের দাবি
তদন্ত কমিশন–সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, প্রতিবেদনে নাম এসেছে এমন অনেক ব্যক্তির নাম এখনো গোপন রাখা হয়েছে। তবে প্রতিবেদনটি জনসম্মুখে প্রকাশ করা হলে সব তথ্য দেশবাসীর সামনে উঠে আসবে।
সরকারের অবস্থান
মঙ্গলবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন—
প্রতিবেদনটি অত্যন্ত বড়, এখনো পুরোটা পড়া হয়নি। তবে সুপারিশসমূহ গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে বাস্তবায়ন করা হবে। ভারতের সম্পৃক্ততা বিষয়ে মন্তব্য করতে তিনি অনীহা প্রকাশ করেন।
২০০৯ সালের ২৫–২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে ৫৭ সেনা কর্মকর্তা সহ মোট ৭৪ জন নৃশংসভাবে নিহত হন। গত ২৪ ডিসেম্বর অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করলে পুনঃতদন্তের পথ খুলে যায়।







