রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ঢাকায় প্রবেশের একটি প্রধান প্রবেশদ্বার। দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চল থেকে প্রতিদিন লাখো মানুষের শহরে প্রবেশের পথ হওয়ায় এলাকায় গড়ে উঠেছে একাধিক সক্রিয় ছিনতাইচক্র। বাসস্ট্যান্ড, টার্মিনাল ও কাউন্টার ঘিরে সব সময় মানুষের ভিড় থাকে, আর সেই সুযোগেই বিভিন্ন কৌশলে পথচারী ও যাত্রীদের টার্গেট করে সর্বস্ব লুটে নেয় দুর্বৃত্তরা।
ঢাকায় নতুন আসা বহু মানুষ প্রতিনিয়ত এসব অপরাধচক্রের শিকার হয়ে জানমাল হারাচ্ছেন। অনেকে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন, ঘটছে মৃত্যুও। অথচ বহু ক্ষেত্রে ঘটনাস্থলে উপস্থিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বিষয়টি উপেক্ষা করেন। অভিযোগ রয়েছে—কিছু ছিনতাইকারী নিয়মিত ‘কমিশন’ দিয়েই তাদের অপকর্ম চালায়। প্রতিদিন অসংখ্য ঘটনা ঘটলেও থানায় নথিভুক্ত হয় অল্প কয়েকটি; বেশিরভাগ ভুক্তভোগী ঝামেলা বা প্রতিশোধের আশঙ্কায় অভিযোগই করেন না।
উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান
গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত এক বছরে ঢাকায় ছিনতাই ও দস্যুবৃত্তির ৪৮৯টি ঘটনা নথিভুক্ত করেছে পুলিশ। জুনে ৩২, জুলাইয়ে ৩৮, আগস্টে ৫২, সেপ্টেম্বরে ৩৬, অক্টোবরে ২৫ এবং নভেম্বরে ২৭টি ঘটনার তথ্য পাওয়া গেছে। বেশিরভাগ ঘটনাই যাত্রাবাড়ী এলাকায় সংঘটিত বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র।
যাত্রাবাড়ী—অপরাধের ঘাঁটি
সরেজমিন দেখা যায়, এলাকায় প্রকাশ্যেই ঘুরে বেড়ায় দুর্বৃত্তরা। বিভিন্ন মোড়ে দলবদ্ধভাবে অস্ত্র হাতে অবস্থান নেয় তারা এবং সুযোগ পেলেই লুটপাট চালায়। স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নিতে গিয়ে কান ছিঁড়ে ফেলার মতো নৃশংস ঘটনাও ঘটছে। এমনকি পুলিশের সামনেই চলছে এসব অপরাধকর্ম। মাদক ব্যবসা, সশস্ত্র মহড়া ও বিভিন্ন অপরাধে এ অঞ্চলকে হটস্পট হিসেবে উল্লেখ করছেন স্থানীয়রা।
চৌরাস্তা, সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড, দোলাইপাড়, জনপথ মোড়, ডেমরা মহাসড়কসহ বিভিন্ন স্থানে ছিনতাইকারী চক্র সক্রিয়। তাদের সদস্যরা রিকশা, বাস বা অটোরিকশার যাত্রীদের পর্যবেক্ষণ করে সুবিধামতো সুযোগে লুট করে।
প্রকাশ্যে ছিনতাইকারীদের বিচরণ—পুলিশ উদাসীন
২৭ নভেম্বর দুপুরে ঢাকা–ডেমরা মহাসড়কে ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ির লাইন দাঁড়ালে দেখা যায়, ‘সবুজ’ নামে এক যুবক পথচারী ও যাত্রীদের ওপর নজর রেখে দৌড়াদৌড়ি করছে। ঘটনাস্থলে থাকা কোনো পুলিশ সদস্যই তার গতিবিধি নিয়ে মাথা ঘামায়নি; বরং সে পুলিশদের পাশেই গিয়ে দাঁড়ায়।
আমার দেশ-এর প্রতিবেদক এ বিষয়ে দায়িত্বে থাকা সার্জেন্ট সামিউলের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, “এটা আমাদের দায়িত্ব নয়।”
ডিএমপির ডিসি (মিডিয়া) মুহাম্মদ তালেবুর রহমানকে বিষয়টি জানালে তিনি বলেন, সার্জেন্টদের এখানে দায়িত্ব নেই; তবে তিনি স্থানীয় থানার ওসিকে বিষয়টি জানাবেন।
ক্রমাগত ছিনতাই ও হামলার ঘটনা
২ ডিসেম্বর ভোরে বধুয়া কমিউনিটি সেন্টারের সামনে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হন জাকির হোসেন, লুট হয় টাকা ও মোবাইল।
২৬ নভেম্বর নারী এনজিওকর্মীকে ছুরিকাঘাত
২০ অক্টোবর সিআইডি সদস্য রাসেল রহমানকে কুপিয়ে লুট
একইদিন শনির আখড়ায় এক কলেজছাত্রকে কুপিয়ে আহত
১২ আগস্ট ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হন পুলিশ কনস্টেবল বাবলু চন্দ্র রায়
অপরাধপ্রবণ এলাকার তালিকা
সিআইডির তথ্যমতে—
১) মিরপুর সবচেয়ে অপরাধপ্রবণ এলাকা
২) মতিঝিল দ্বিতীয়
৩) যাত্রাবাড়ী তৃতীয়
এসবি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড, চৌরাস্তা, দোলাইপাড় মোড় ও আশপাশে ছিনতাইকারীরা বেশি সক্রিয়। ডেমরা, কদমতলী ও মেরাজনগর এলাকার কিছু অংশেও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘনঘন ঘটে।
পুলিশ কী বলছে
ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার ডিআইজি শফিকুল ইসলাম বলেন, প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ঘোরার বিষয়টি তার জানা নেই এবং ছুরিকাঘাতের ঘটনাও তিনি অবগত নন। তবে তিনি ওসির সঙ্গে কথা বলবেন।
যাত্রাবাড়ী থানার ওসি কামরুজ্জামান তালুকদার জানান, অপরাধ আগের তুলনায় কমেছে, তারা তৎপর আছেন এবং বেশ কয়েকটি জায়গায় সিসিটিভি স্থাপন করা হয়েছে। কেন অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আসছে না—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, নিয়মিত গ্রেপ্তার অভিযান চলছে এবং ভবিষ্যতে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।







