আজকের দিনে জিয়াউর রহমানকে বাদ দিয়ে আর কোনো বিষয়ে লিখতে পারছি না। তাই শহীদ জিয়া, তার প্রিয় স্বদেশ এবং তারই গড়া দল নিয়েই কথা থাকবে আজকের এ লেখায়। ১৯৮১ সালের ৩০ মের গভীর রাতে বাংলাদেশের ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়ের সূচনা হয়। চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে বিপথগামী একদল সেনা অফিসারের নির্মম বুলেটে স্তব্ধ হয়ে যায় বাংলাদেশের এক স্বপ্নদ্রষ্টা আপসহীন রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমানের জীবন। সেই রাতে শুধু একজন রাষ্ট্রপতি নন, শহীদ হয়েছিলেন একটি জাতির স্বপ্ন, একটি সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের অঙ্গীকার।
তার শাহাদাত ছিল আকস্মিক, অপ্রত্যাশিত এবং বাংলাদেশের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। যে মানুষটি দেশকে অর্থনৈতিক মুক্তির পথে এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাকেই এমন নৃশংসভাবে চলে যেতে হলো। জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন দূরদর্শী নেতা এবং একজন দেশপ্রেমিক, যিনি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য আমৃত্যু কাজ করে গেছেন।
৩০ মে রাতের সেই ঘটনা আজও বাংলাদেশের মানুষকে ব্যথিত করে তোলে। তার মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের জন্য নয়, সমগ্র জাতির জন্য ছিল এক বিশাল শোক। তার অনুপস্থিতি আজও অনুভূত হয়, বিশেষ করে যখন আমরা একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, যে স্বপ্ন তিনি আমাদের মাঝে বুনে দিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান শারীরিকভাবে না থাকলেও তার আদর্শ, তার দেশপ্রেম এবং তার অদম্য কর্মপ্রেরণা আজও আমাদের অনুপ্রেরণা জোগায়। তার শাহাদাত দিবস তাই শুধু একটি শোকের দিন নয়, এটি তার প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা জানানোর এবং তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের অঙ্গীকারের দিন।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কর্মময় জীবনটাই ছিল ইতিবাচকতায় ভরপুর। দেশ, জাতি ও জনগণের জন্য তিনি রেখে গেছেন অনন্যসাধারণ ইতিবাচক অবদান। অপরদিকে তার যারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, তাদের নেতিবাচকতা ও ব্যর্থতার অন্ত নেই। তারা জাতীয় প্রয়োজনের মুহূর্তে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করতে পারেননি। স্বাধীনতার পর দেশ গঠন করতে পারেননি। গণতন্ত্র, সুশাসন ও ন্যায়বিচার কায়েম করতে পারেননি। তারা দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করতে পারেননি। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি। বাক, ব্যক্তি, সংবাদপত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারেননি। ‘বাংলাদেশ ইজ আ ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেট কেস’—এ বদনাম ঘোচাতে পারেননি। জিয়াউর রহমান খুবই সাফল্যের সঙ্গে এসব করতে পেরেছিলেলেন। তাই প্রতিপক্ষের স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে, শহীদ জিয়ার বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক বৈরী প্রচারণার মাধ্যমে তার ভাবমর্যাদাকে ডিফেন্সিভ অবস্থানে ঠেলে দেওয়া, যাতে তার ইতিবাচক কর্মকাণ্ড এবং তাদের নিজেদের ব্যর্থতাকে আড়াল করা যায়।
জিয়াউর রহমানের আদর্শ, কর্মসূচি ও জীবনাচরণ অনুসরণ না করে কেবল তার নাম জপে লাভ নেই কোনো। কথামালার মানুষ ছিলেন না তিনি। অন্যদের উদ্দেশে ভাষণ বা নির্দেশনা দিয়ে দায় সারার লোক ছিলেন না; নিজে কাজ করতেন, অ্যাকশন নিতেন, আর সেই কাজ অন্যকেও করার আহ্বান জানাতেন।
সেই একাত্তরে হানাদার-আক্রান্ত স্বদেশে বিদ্রোহ করলেন ‘উই রিভোল্ট’ বলে। গড়ে তুললেন প্রতিরোধের যুদ্ধ। ঘোষণা দিলেন স্বাধীনতার। সেই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যা যা করা দরকার বলে মনে করেছেন, তার সবই করেছেন জীবনের মায়া ত্যাগ করে। একই কাণ্ড ১৯৭৫ এবং তার পরবর্তী কালেও। যতদিন বেঁচে ছিলেন তা-ই করে গেছেন। হি ওয়াজ নট অনলি এ ভিশনারি লিডার, হি ওয়াজ এ ম্যান অব অ্যাকশন। তার দূরদর্শিতা, দেশপ্রেম, সাহস, বীরত্ব, সততা, দক্ষতা, কর্মক্ষমতা, পরিকল্পনা, জনঘনিষ্ঠতা, ঔদার্য, আড়ম্বরহীনতা—সবকিছুই কিংবদন্তি হয়ে আছে।
এমন একজন রাষ্ট্রনায়ক যখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল দেশ ও জাতির জন্য, তখনই ষড়যন্ত্রের হিংস্র ছোবল তাকে ছিনিয়ে নিয়েছে।
তিনি আর কোনোদিন সশরীরে ফিরবেন না আমাদের মাঝে। তাই আজ প্রয়োজন তার দিকনির্দেশনা, আদর্শ, কর্মসূচি ও তার ব্যক্তিগত জীবনাচরণ অনুসরণ ও অনুকরণ করা। তাতেই সংকট উত্তরণ ও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব।
তা না করে কেবল তার নাম জপ করে কোনো লাভ হবে না, বরং সেটা হবে নিছক হিপোক্রেসি। সব সময় তিনি সেই হিপোক্রেসির বিরুদ্ধেই সোচ্চার ছিলেন।
রাজনীতি ও রাষ্ট্রপরিচালনায় জিয়াউর রহমানের অসামান্য সাফল্যের মূল কারণ কী ছিল? কোনো দর্শন ও কর্মসূচির অনুসারীরা যখন আশপাশের অনেক কিছুকেই অন্যদের তুলনায় বেশি অ্যাকোমডেট করার ক্ষমতা রাখে, তখনই সাফল্য ও বিজয়ের পথ রচিত হয় সেই দর্শন ও কর্মসূচির। যে-আদর্শের পতাকাতলে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য গড়ার সুযোগ যত বেশি, সেই আদর্শ তত বেশি অজেয়। যে রাজনৈতিক দল সমাজের যত বেশি সংখ্যক মানুষের স্বার্থ ও চিন্তাকে ধারণ করতে পারে, সে-দল তত বড় ও শক্তিশালী হয়।
রবিঠাকুর ‘ক্ষণিকা’য় দু’লাইনের চমৎকার ছন্দোবদ্ধ এক প্রবচন লিখে গেছেন। দ্বিপদী সেই কবিতাটিকে দারুণ সত্য বলে মনে হয় আমার কাছে। সেটি হলো—
‘উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে
তিনিই মধ্যম যিনি থাকেন তফাতে।’
এর সঙ্গে চলা যাবে না, একে দূরে রাখতে হবে, ওকে এড়িয়ে চলতে হবে, তাকে ছোঁয়া যাবে না—এ ধরনের ছুঁতমার্গে বিশ্বাসী লোকদের রবীন্দ্রনাথ ভদ্রতা করে মধ্যম বা মাঝারি মানের লোক বলেছেন। তবে তিনি উন্নত ও উত্তম বলেছেন তাদেরই, যারা নিশ্চিন্তে কোনো রকম দ্বিধা-দ্বন্দ্বে না ভুগে অধম-সহ সকলকে সঙ্গে করেই পথ চলতে পারে। রাজনীতি ও কূটনীতিসহ সব নীতিতেই এই কথাটি সত্য ও প্রয়োগযোগ্য। যত বেশি স্রোতধারাকে চলার পথে আপনি সঙ্গে নেবেন, যত বেশি ধারাকে আপনার সঙ্গে মিলতে দেবেন, তত বেশি শক্তিশালী ও বেগবান হবে আপনার মূলধারা।
অন্যদের যত বেশি সম্ভব সঙ্গে রাখার এই যে যোগ্যতা, এটাই নেতৃত্বের দক্ষতা। ছোটখাটো অন্যমত, ভিন্নমত, ধারা-উপধারাকে আত্মস্থ ও অ্যাকোমডেট করার ক্ষমতা-সাধ্য-সামর্থ্য যে-আদর্শের যত বেশি, সেই আদর্শ তত মহৎ, তত উদার, তত বড়। কূপমণ্ডূকেরা অন্যমত সহ্য করতে পারে না। তারা জানে, তাদের আদর্শ এত সংকীর্ণ যে, অন্য কোনো আদর্শকে পাশে আসতে দিলেই তাদেরটা ম্লান হয়ে যাবে। অন্য কোনো মতামতকেই তাই তারা সহ্য করতে পারে না। জবরদস্তি করে সব ভিন্নমতকে অবদমিত বা নিশ্চিহ্ন করাটাই তাদের লক্ষ্য।
এই সংকীর্ণতা ও অসহিষ্ণুতার বিপরীতে বাংলাদেশে দাঁড়িয়েছিলেন জিয়াউর রহমান নামের একজন মানুষ। সে কারণেই এদেশে সাফল্যের সিংহদরজা খুলে গিয়েছিল তার সামনে। তিনি রাজনৈতিক ভাবাদর্শের ডান ও বাম সকলকে দুহাতে ধরে সঙ্গে নিয়ে নিজে মধ্যপথ দিয়ে নিশ্চিন্তে এগিয়ে গিয়েছেন নির্ধারিত গন্তব্যের দিকে। প্রবীণের অভিজ্ঞতা ও তারুণ্যের কর্মশক্তি এই দুই মণি-কাঞ্চনযোগে তিনি বেগবান করেছেন তার সাফল্যের স্রোতধারাকে। তিনি বামঘেঁষা ভাসানী ন্যাপকে তার রাজনৈতিক দল গঠনের মূলস্রোত হিসেবে বেছে নিলেও ডানপন্থি রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের জন্যও তার দলের দুয়ার উন্মুক্ত করে রেখেছিলেন। একই সঙ্গে তার রাজনৈতিক অভিযাত্রায় কৃতী পেশাজীবীদেরও সঙ্গী করেছিলেন শহীদ জিয়া। তিনি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করতেন, তার আদর্শ এত ঠুনকো নয় যে, অন্য কোনো আদর্শের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তা টিকবে না, কিংবা অন্যমতের সংস্পর্শে এলেই তার মতবাদ হারিয়ে যাবে। তিনি এই দৃঢ় আত্মবিশ্বাসে ভর করেই দেশপ্রেমিক, সৎ, যোগ্য, দক্ষ ও মেধাবী মানুষদের খুঁজে খুঁজে এনে একত্র করেছিলেন তার কর্মযজ্ঞের সারথি হিসেবে। তারা প্রায় প্রত্যেকেই নিজ নিজ অঙ্গনে নক্ষত্রের মতন দীপ্তিমান ছিলেন। শহীদ জিয়ার নেতৃত্বে গঠিত রাজনৈতিক দল ও সরকারকে তাই তখন বলা হতো ‘গ্যালাক্সি অব স্টার্স’। বাংলায় তরজমা করলে বলতে হয়, তিনি তারকাখচিত ছায়াপথ রচনা করেছিলেন।
তার সমকালে নিজের দল ও সরকারের বাইরেও যারা অন্যমতের যোগ্য মানুষ ছিলেন, তিনি তাদের যথেষ্ট সম্মান করতেন। ডেকে এনে তাদের মতামত গুরুত্বসহ শুনতেন। অনেককেই তিনি যোগ্যতা অনুযায়ী কাজে লাগাতেন, দায়িত্ব দিতেন। তার নিজের সমালোচনাকেও তিনি উৎসাহিত করতেন এবং এর মধ্য দিয়েই ভুলত্রুটি মুক্ত হয়ে সঠিক পথ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করতেন।
জিয়াউর রহমানের ওপর যখন রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হয়, তখন দেশে রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ ছিল এবং কোনো রাজনৈতিক দলও ছিল না। তিনি রাজনীতিকে শেকলমুক্ত করেন এবং রাজনৈতিক দল গঠনের অধিকার অবারিত করেন। কোনো দলমতকেই নিষিদ্ধ করে রাখার পক্ষপাতী ছিলেন না শহীদ জিয়া। সহিংস ও গুপ্ত রাজনৈতিক তৎপরতার অবসানকল্পে বাংলাদেশের নাগরিকদের তিনি যেকোনো মতামতের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল গঠনের অধিকার দেন। তিনি ভিনদেশে রাজনৈতিক আশ্রিতদের দেশে ফিরে রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত হওয়ারও সুযোগ দেন। কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শকে গ্রহণ কিংবা বর্জনের ব্যাপারে সরকারের কর্তৃত্ব ও এখতিয়ারকে খর্ব করে তিনি সে-অধিকার জনগণের হাতে অর্পণ করেন। তার নেওয়া এসব পদক্ষেপের ফলে সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাসী বামপন্থিরা অনেকে এবং ধর্মাশ্রয়ী ডানপন্থি দলগুলো গুপ্ত তৎপরতা ছেড়ে নিয়মতান্ত্রিক প্রকাশ্য রাজনীতির ধারায় ফিরে আসে। এসব পদক্ষেপ ও নীতির কারণেই শহীদ জিয়াউর রহমানের রাজনীতিকে জাতীয় ঐক্যের রাজনীতির অভিধায় চিত্রিত করা হয়। তার সে রাজনীতি এতটাই লোকপ্রিয় ও দুর্নিবার হয়ে ওঠে যে, রাজনীতির প্রচলিত কোনো ধারার পক্ষেই এর অগ্রযাত্রা ও সাফল্য রোধ করা সম্ভব হয়নি। তার রাজনীতির সর্বব্যাপী এই গ্রহণযোগ্যতার কারণেই অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে টিকে থাকা শহীদ জিয়ার আদর্শই এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উৎকণ্ঠার প্রধান কারণ হয়ে আছে।
জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর বেগম খালেদা জিয়া তার শহীদ স্বামীর আদর্শ ও কর্মধারা যতটা সম্ভব অনুসরণ করেই দলকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে দেশের রাজনীতিতে আবারও অসহিষ্ণু, অনুদার, হিংসুটে ও ছোট মাপের লোকেরা প্রাধান্য বিস্তার করেছে। আচরণ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির দিক থেকে তারা শহীদ জিয়ার সম্পূর্ণ বিপরীত। এদের সার্বক্ষণিক বুলিই হচ্ছে, ‘এরে তাড়াও, ওরে খেদাও, তারে নির্মূল করো।’ এ ছাড়া যেন এদের মুখে আর কোনো কথা নেই। নিন্দাবাদ, কুৎসা ও নোংরা পরচর্চাই এদের প্রধান পুঁজি। এরা মতামতের শতফুল ফুটতে দেওয়ার নীতিতে বিশ্বাসী নয়। এদের কথা হচ্ছে, ‘আমার সঙ্গে একশ ভাগ না মিললে, শতভাগ আমার অনুগত না হলেই সে আমার শত্রু।’
রাজনৈতিক এই অপসংস্কৃতি শুধু রাজনীতির দুর্দশাই নয়, দেশের দুর্গতির জন্যও দায়ী। চরম অসহিষ্ণু এই অপসংস্কৃতির চর্চায় দলগুলো যোগ্য লোকশূন্য হয়ে পড়ছে এবং অযোগ্যরা জেঁকে বসছে। সুবিধাশিকারি, দুর্নীতিগ্রস্ত, ধান্দাবাজ ও মন্দ লোকেরা একে একটা মওকা হিসেবে নিয়েছে। এই অসহিষ্ণুতাকে আরো উসকে দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে উগ্র স্লোগানের আড়ালে তারা নিজেরা বিভিন্ন সেক্টরে লুটেপুটে খাচ্ছে, দেশটাকে ফোকলা করে ফেলেছে।
শহীদ জিয়ার শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে তারই প্রতিষ্ঠিত জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির উদ্দেশে কিছু কথা বলা দরকার। দলটিকে আবারও রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের জন্য অপেক্ষমাণ বলা চলে। এ সময়ে ঘাত-প্রতিঘাত ও সাফল্য-ব্যর্থতার অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ দলটির ফের শহীদ জিয়ার রাজনৈতিক সংস্কৃতিকেই দৃঢ়ভাবে ধারণ করার সময় এসেছে বলে আমি মনে করি। কেননা বিপরীত রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির সংক্রমণ বিএনপিকেও ইতোমধ্যে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। জাতীয়তাবাদী রাজনীতিও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার জেরে ধুঁকছে তীব্র সংকটে।
অনেক দিন ধরে, বিশেষ করে ২০০১ সালে সরকার গঠনের পর থেকেই দলের ভেতরে একটি স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে একটি অপকৌশলের প্রয়োগ শুরু করে। অপকৌশলটি হচ্ছে—‘যোগ্যদের ভিড়তে দিও না, দক্ষদের তাড়িয়ে দাও।’ এর ফলে দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে ঘিরে মেধাবী, যোগ্য, দূরদর্শী, কৌশলী, দেশপ্রেমিক, সৎ ও দক্ষ একদল উপযুক্ত মানুষের যে বলয় থাকার কথা, নেতৃত্বের সে বলয় ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে গেছে। এই শূন্যস্থান যারা পূরণ করেছেন, তাদের নিজেদের অবস্থান তৈরি ও নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার তৎপরতাতেই ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। দেশের কিংবা দলের প্রতি অবদান রাখার অবকাশ তাদের হয়নি এবং আরেকটু কঠিন ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, সে সামর্থ্য বা যোগ্যতাও তাদের অনেকেরই হয়নি।
এখনো এ দলের প্রতি জনসাধারণের বিপুল সমর্থনের কমতি বা মাঠের কর্মীর অভাব হয়নি, এ-কথা সত্য; কিন্তু রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতি, প্রশাসনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণ ও যোগাযোগ রক্ষার মতন উপযুক্ত ব্যক্তিত্বের দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় আওয়ামী লীগের পতিত ফ্যাসিস্ট রেজিমের সর্বব্যাপী ব্যর্থতার পটভূমিতে বিএনপিতেও দক্ষ-যোগ্য একটি ডাইনামিক সরকার ও মন্ত্রিসভা গঠনের উপযোগী টিমের প্রকট অভাব এখন দেশি-বিদেশি স্টেকহোল্ডারদের চোখেও দৃষ্টিগ্রাহ্য। দীর্ঘদিন ধরে আমরা দেখে আসছি ব্যাপক জনসমর্থন, বিপুল কর্মিশক্তি, ভিনদেশের লেজুড়বৃত্তিমুক্ত দেশভিত্তিক স্বাধীন রাজনীতি এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে জনস্বার্থঘনিষ্ঠ বাস্তবমুখী প্রয়োগযোগ্য কর্মসূচি থাকা সত্ত্বেও কেবল কূটকৌশলের অপ্রতুলতায় বিএনপিকে হেরে যেতে। সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে তারা। পরিস্থিতি ও সময় বুঝে কখন দু-পা এগোতে হয়, আবার কখন এক-পা পিছিয়ে আসতে হয়, বারবার ভুল হয়েছে সে কৌশল ও সময় নির্ধারণেও। বিএনপিকে মিনিমাম স্যাক্রিফাইসে ম্যাক্সিমাম গেইন করার ব্যাপারে সবচেয়ে দক্ষ পার্টি বলে একসময় সবাই জানত। অথচ ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের সময়ে তারা সে ম্যাচিওরিটির পরিচয় দিতে পারেনি। ফলে অনেক বেশি ত্যাগের বিপরীতে দলের অর্জন হয়েছে সামান্য। ফ্যাসিবাদ উচ্ছেদে নেতৃত্ব দেওয়ার অবিসংবাদিত কৃতিত্বও বিএনপি অর্জন করতে পারেনি।
বিরাট রাজনৈতিক আদর্শ-সংবলিত বিপুল সমর্থনধন্য একটি বিশাল রাজনৈতিক দলের যেমন আচরণ হওয়া উচিত, বিএনপি যেন তেমন আচরণ করতেও ভুলে গেছে। সব স্তরে মতাদর্শের চর্চা এবং গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুশীলনের মাধ্যমে নেতৃত্ব সৃষ্টির ধারা নানা অজুহাতে স্থগিত করে রেখে ওপর থেকে পদ-পদবি বণ্টনের প্রক্রিয়াও দলকে গতিহীন, নিস্তরঙ্গ ও স্থবির করে ফেলেছে। কেবল দল নয়, এসব দুর্বলতা, সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটির ভিকটিম হচ্ছে দেশ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকরাও। অচিরেই নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের জন্য অপেক্ষমাণ বিএনপি বিষয়গুলো খুব ভালো করে খতিয়ে দেখবে এবং প্রয়োজনে পুনর্মূল্যায়ন করবে—নীতিনির্ধারকদের কাছে এটাই প্রত্যাশা।
একুশ শতকের উপযোগী একটি আধুনিক, গতিশীল, অভিজ্ঞতায় পরিপুষ্ট, তারুণ্যখচিত ও মেধাচর্চিত দল গঠনের পাশাপাশি বিএনপিকে একটি দক্ষ, যোগ্য ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী সরকারের টিম গড়ে তোলায় এখনই সক্রিয় হতে হবে। সেটাই হবে শহীদ জিয়ার স্মৃতির প্রতি সর্বোত্তম শ্রদ্ধা নিবেদন।