২০০৯ সালের বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পর সেনাবাহিনীতে যে ভয়, সন্দেহ ও অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল—সেই পরিস্থিতিকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল বলে জানিয়েছে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের স্বাধীন তদন্ত কমিশন। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনাটির সত্য অনুসন্ধানে সোচ্চার পাঁচ সেনা কর্মকর্তাকে পরিকল্পিতভাবে ‘জঙ্গি আতঙ্ক’ দেখিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়। তাদের আটক, নির্যাতন এবং গুমের হুমকি দিয়ে সেনাবাহিনীর ভেতরে ভয় ছড়ানোই ছিল আসল উদ্দেশ্য।
সাজানো ‘তাপস হত্যাচেষ্টা মামলা’
কমিশনের সাক্ষ্যে উঠে আসে—ফজলে নূর তাপসকে আজীবন নিরাপত্তা দেওয়ার দাবি ও সেনাবাহিনীতে ভয় তৈরি করার উদ্দেশ্যে সম্পূর্ণ সাজানো ও মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে ‘তাপস হত্যাচেষ্টা মামলা’ দাঁড় করানো হয়। যাতে কোনো সেনা কর্মকর্তা বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে না পারেন।
তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, সেনাবাহিনীর ভেতরে ‘ইসলামি জঙ্গিবাদ’ আছে—এমন বর্ণনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই প্রথমবারের মতো ইউনিফর্ম পরিহিত সেনাসদস্যদের গুমের ঘটনা ঘটানো হয়। ভয়, বিভ্রান্তি ও নীরবতা তৈরি করে সেনাবাহিনীর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাই ছিল কেন্দ্রীয় লক্ষ্য।
তাপস নিজেই কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি
মামলার বাদী তাপস আদালতে কোনো সাক্ষ্য বা প্রমাণ দেখাতে ব্যর্থ হন। পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে মামলাটিকে ‘ভিত্তিহীন’ ঘোষণা করা হয়। সেখানে বলা হয়, মামলায় কোনো সামরিক কর্মকর্তার নামও ছিল না।
যাদের টার্গেট করা হয়েছিল
বিডিআর হত্যাকাণ্ডের তদন্ত, উদ্ধার ও আলামত সংগ্রহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা পাঁচ সেনা কর্মকর্তা ছিলেন:
ক্যাপ্টেন রেজাউল করিম
ক্যাপ্টেন খন্দকার রাজীব হোসেন
মেজর হেলাল
ক্যাপ্টেন সুবায়েল বিন রফিক
ক্যাপ্টেন মো. ফুয়াদ খান
তারা ঘটনাপরবর্তী সময়ে উদ্ধার পরিকল্পনা, জোরালো প্রতিবাদ এবং উচ্চ পর্যায়ে বিচার দাবি করায় একে একে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন।
তদন্তকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার অভিযোগ
তৎকালীন ডিজিএফআই প্রধান মেজর জেনারেল ফজলে আকবর, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সালেহ এবং ঢাকা সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আজিজ—এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে, তারা ‘তাপস হত্যাচেষ্টা মামলা’কে ভিন্ন দিকে নিয়ে যেতে ভূমিকা রাখেন।
বন্দি কর্মকর্তাদের ওপর নির্যাতন
সাক্ষ্য অনুযায়ী, আটক কর্মকর্তাদের এক মাস ধরে জেআইসিতে নির্যাতন, সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেওয়া এবং পরিবারকে ব্ল্যাকমেইল করার মতো অভিযোগ উঠে এসেছে। একজন ব্রিগেডিয়ার সাক্ষ্যে বলেছেন, তদন্ত আদালতে হাজির করার সময় কর্মকর্তারা ছিলেন “সম্পূর্ণ ভেঙে পড়া” অবস্থায়।
আলামত নিয়ে অসংগতি
তদন্তের তথাকথিত আলামত—মোবাইল নকশা, বিস্ফোরক, ডেটোনেটর ও ট্রাংকভর্তি অস্ত্র—এসবই অবিশ্বাস্য ও অসংগত বলে সাক্ষ্যে উল্লেখ করেন ইউনিট কমান্ডাররা। বিশেষ করে ১৬ ইসিবি ক্যাম্পে নাকি অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে—এ দাবিকে সম্পূর্ণ মিথ্যা বলেন সংশ্লিষ্ট কমান্ডাররা।
পুলিশের ডিবি কর্মকর্তারাও জানান—তাপসের ওপর কোনো হত্যাচেষ্টা ঘটেনি।
চূড়ান্ত মূল্যায়ন
তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘তাপস হত্যাচেষ্টা মামলা’ মূলত ছিল একটি সাজানো নাটক—যার উদ্দেশ্য সত্যকে ধামাচাপা দেওয়া, সেনাবাহিনীকে স্তব্ধ করা এবং পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মূল রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাকে আড়াল করা।







