চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে চন্দ্রনাথ পাহাড়কেন্দ্রিক ইস্যুতে ফের তৎপর হয়ে উঠেছে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ইসকন—এমন অভিযোগ উঠেছে। জামায়াতে ইসলামীর একটি পিকনিককে কেন্দ্র করে পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়িয়ে এলাকায় অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে স্থানীয়দের দাবি। ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একাধিক পোস্ট দিয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা উসকে দেওয়ার অপচেষ্টাও চলছে।
রাজনৈতিকভাবে সচেতন মহলের বক্তব্য, আওয়ামী লীগ ও ভারতের কথিত নীলনকশায় ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও জুলাই বিপ্লবের নায়ক ওসমান হাদির ওপর হামলা ও হত্যাচেষ্টা নিয়ে সারাদেশে যখন বিচার দাবিতে উত্তাল পরিস্থিতি, ঠিক সেই সময় ঘটনাকে ভিন্নখাতে নিতে পরিকল্পিতভাবে এই গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এতে ইসকন ও আওয়ামী লীগের একটি অংশ জড়িত বলে অভিযোগ তাদের।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, শুক্রবার দুপুরে সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পাদদেশে দুই নম্বর গেটসংলগ্ন পাহাড়ি বাগানে একটি পিকনিকের আয়োজন করা হয়। এ আয়োজন করেন জামায়াতের সাবেক আমীর তাওহীদুল হক চৌধুরী। পিকনিকে শতাধিক সনাতনী ধর্মাবলম্বী ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ অংশ নেন। স্থানটি মহাশ্মশ্মান খেক থেকে প্রায় এক হাজার মিটার পূর্বে, সীতার মন্দির থেকে এক হাজার মিটার পশ্চিমে এবং চন্দ্রনাথ মন্দির থেকে প্রায় ১২০০ ফিট নিচে অবস্থিত। জামায়াতের পাশাপাশি সংগঠনের সনাতনী শাখার নেতারাও মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন। এছাড়া প্রায় ৫০ জন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর জন্য আলাদা মেন্যুতে খাবারের ব্যবস্থাও করা হয়।
কিন্তু পরদিন চট্টগ্রামের কয়েকজন আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি বিষয়টিকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়াতে শুরু করে। প্রথমে বিপ্লব দে পার্থ নামে এক ব্যক্তি ‘চন্দ্রনাথ ধর্মীয় তীর্থভূমিতে জামায়াত নেতার গরু জবাই’ শিরোনামে একটি পোস্ট দেন। সেখানে তিনি দাবি করেন, জামায়াত আয়োজিত পিকনিকে শত শত নেতাকর্মী ও এক হাজারের মতো মানুষ অংশ নেয় এবং চন্দ্রনাথ ধামের নিকটবর্তী এলাকায় গরু জবাই, ইসলামী সংগীত পরিবেশন, আজান ও নামাজ আদায় করা হয়। তিনি আরও লেখেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে হিন্দুরা প্রতিবাদ করতে পারেনি এবং চন্দ্রনাথ ধামের জায়গা জবরদখলের সঙ্গেও জামায়াত জড়িত।
এই পোস্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। অভিযোগ রয়েছে, বিপ্লব দে পার্থের সঙ্গে ইসকনের সংশ্লিষ্টতা আছে। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ ও আইনজীবী আলিফ হত্যা মামলার আসামি চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগও রয়েছে। আরও অভিযোগ রয়েছে, অতীতে তিনি ইসকনের বিভিন্ন প্রেস বিজ্ঞপ্তি গণমাধ্যমে পাঠাতেন এবং সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় মুসলমানদের দায়ী করে বিভ্রান্তিকর পোস্ট দিতেন।
স্থানীয়রা জানান, চন্দ্রনাথ মন্দির পাহাড়ের প্রায় ১২০০ ফিট উপরে অবস্থিত। যেখানে পিকনিক করা হয়েছে, সেটি পাহাড়ের নিচের লোকালয় এবং দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত একটি পিকনিক স্পট। এর আগে সীতাকুণ্ড বাজার কমিটিসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন সেখানে পিকনিক করেছে। পাহাড়ের পাদদেশে বহু বসতবাড়ি রয়েছে এবং কাছেই টিনওয়ালাশাহ ফকির (রহ.)-এর একটি মাজারও আছে। যদিও এলাকায় একাধিক মঠ ও মন্দির রয়েছে, তবুও যুগ যুগ ধরে সেখানে মুসলমানদের বসবাস ও চাষাবাদ চলে আসছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পিকনিকে ব্যবহৃত গরুর মাংস বাইরে থেকে জবাই করে আনা হয়েছিল। পিকনিক স্পটটির সঙ্গে মহাশ্মশ্মান ও সীতার মন্দিরের দূরত্ব প্রায় এক হাজার মিটার। এক নম্বর ব্রিজ পার হয়ে পাহাড়ি ছড়ার ওপারে পেয়ারা ও গাবের বাগানের ভেতরেই আয়োজনটি করা হয়।
পূজা কমিটির নেতা বলরাম দাস বলেন, “পাহাড়ের পাদদেশে ফলের বাগানে পিকনিকে গরু ও খাসি জবাই করে খাওয়ানো নতুন কিছু নয়। এসব বাইরে থেকেই জবাই করে আনা হয়। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হচ্ছে, তা স্পষ্টতই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের ষড়যন্ত্র।”
উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি অমলেন্দু কনক বলেন, “একটি অসাধু চক্র সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এবং আসন্ন নির্বাচন বানচাল করতে পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়াচ্ছে। মাওলানা তাওহীদুল হক চৌধুরী তাঁর আমিরাবাদের বাড়িতে গরু ও খাসি জবাই করে অনুষ্ঠানস্থলে এনে শুধু রান্না করেছেন।”
তাওহীদুল হক চৌধুরী বলেন, “আমার বাড়ি থেকেই রান্না করা খাবার নেওয়া হয়েছে। আশপাশে কোনো মন্দির বা মঠ নেই। মনোরম পরিবেশের কারণে পাহাড়ের ওই বাগানটি বেছে নেওয়া হয়। চন্দ্রনাথ মন্দির পাহাড়ের অনেক ওপরে।”
চট্টগ্রাম-৪ আসন (সীতাকুণ্ড) থেকে জামায়াতের সংসদ সদস্য প্রার্থী আনোয়ার সিদ্দিক চৌধুরী বলেন, “হাদির ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নিতে এই অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। সীতাকুণ্ডের ঐতিহ্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে একটি মহল পরিকল্পিতভাবে উসকানি ছড়াচ্ছে।







