প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ইংল্যান্ড সফরের সময় আওয়ামী লীগের প্রধান কর্মসূচি ছিল সেখানকার প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে বৈঠক ঠেকানো। এতে সফল হয়েছে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ দলটি। গত ১০ থেকে ১৩ জুন পর্যন্ত ব্রিটেনে অবস্থান করেন ড. ইউনূস।
এর মধ্যে অনেক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হয়। দেশটির প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও বৈঠকের সম্ভাবনা ছিল। বিষয়টি চূড়ান্ত হওয়ার আগেই তৎপর হয় আওয়ামী ষড়যন্ত্রকারীরা। এ কারণে শেষমেষ আর সাক্ষাৎটি হয়নি।
আওয়ামী ষড়যন্ত্রের কারণে স্টারমারের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক নিয়ে টানাপড়েন শুরু হয়। প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বারবার বলেছিলেন যে, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের জন্য চেষ্টা অব্যাহত ছিল। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত বৈঠকটি ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে ব্রিটেনে তৎপর আওয়ামী ষড়যন্ত্রকারীরা। কেন প্রধান উপদেষ্টা ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে বৈঠকটি হয়নি তা নিয়ে অনুসন্ধান চালায় আমার দেশ, পাওয়া গেছে নানা তথ্য।
অনেকেই মনে করেন, শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক বৈঠক ঠৈকানোর পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন। তার প্রভাব রয়েছে সেখানকার ক্ষমতাসীন লেবার পার্টিতে। তিনি তৃতীয়বার সংসদ সদস্য হয়েছেন। পেয়েছিলেন মন্ত্রিত্ব। কিন্তু শেখ হাসিনার দুর্নীতি, লুটপাট ও দুঃশাসনের সঙ্গে তার নামও জড়িয়ে থাকায় নিজ দলে কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়েন টিউলিপ। হারিয়েছেন মন্ত্রিত্ব। তারপরও টিউলিপ তার প্রভাব কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন। পাশাপাশি ব্রিটেনে অবস্থান করা আওয়ামী লীগের লোকজনও ছিল মরিয়া।
আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তাদের মূল কর্মসূচি ছিল কোনো অবস্থায়ই যাতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা দেখা করতে না পারেন। এমন নির্দেশনাই ছিল ভারতে পলাতক শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে। এতেই তৎপর হয় আওয়ামী লীগের ব্রিটেন শাখা।
আওয়ামী লীগের একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অন্তত ৮০ ব্রিটিশ এমপিকে তারা কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছেন। ওইসব এমপি দুই দেশের সরকার প্রধানের সাক্ষাৎ ঠেকাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বসতে শেষ পর্যন্ত সম্মতি দেননি স্টারমার। তবে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল ৮০ শতাংশ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ব্রিটেনের সব এলাকায় আওয়ামী লীগ ষড়যন্ত্রকারীদের অবস্থান। যারা আবার ব্রিটেনের স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত। দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় রাজনীতিতে জড়িত অনেকেই লেবার পার্টির বড় পদেও আছেন। সবাই নিজ নিজ এলাকায় স্থানীয় সংসদ সদস্যদের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করেছেন। স্থানীয় রাজনীতি ও স্থানীয় সংসদ সদস্যদের সঙ্গে বন্ধুত্বকে কাজে লাগানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক ঠেকানোর লক্ষ্যে।
ব্রিটেন আওয়ামী লীগ নেতাদের মতে, ৭০ থেকে ৮০ জন সংসদ সদস্য একযোগে তৎপর না হলে এই বৈঠক ঠেকানো কোনো অবস্থায়ই সম্ভব হতো না। একেবারে শেষ পর্যায়ে স্টারমারের পার্শ্ববর্তী সংসদীয় আসনের ৪ সদস্য একসঙ্গে তার সঙ্গে দেখা করেন। তারা স্টারমারকে বোঝাতে সক্ষম হন, যাতে ড. ইউনূসের সঙ্গে দেখা না করেন।
গণঅভ্যুত্থানে পলাতক আওয়ামী লীগের চার মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীও বর্তমানে ব্রিটেনে আছেন। এছাড়া দলটির অনেক এমপি-নেতাও পালিয়ে আছেন দেশটিতে। তারা সম্মিলিতভাবে ষড়যন্ত্রে অংশ নেয়।
শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসন আমলে আওয়ামী লীগের লুটেরা নেতাদের প্রচুর টাকা ইংল্যান্ডে পাচার করা হয়েছে। তাদের অনেকেই ব্রিটেনে বিলাসবহুল এলাকায় বাড়ি কিনেছেন। বিপুল অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করেছেন দেশটির রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। তার রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় বিপুল বিনিয়োগে সাড়ে ৩শ’র বেশি বাড়ি রয়েছে ব্রিটেনে। এর মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার সফরকালে বেশ কয়েকটি বাড়ি জব্দ করেছে ব্রিটেন সরকার।
সম্প্রতি সালমান এফ রহমানের ছেলের বেশ কয়েকটি বিলাসবহুল বাড়ি জব্দ করেছে ব্রিটেন সরকার। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত অব্যাহত রয়েছে বলে জানা গেছে।
প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গীদের মধ্যে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও ছিলেন। তাদের সফরসঙ্গী হিসেবে রাখার উদ্দেশ্য ছিল দুর্নীতির মাধ্যমে পাচার করে ব্রিটেনে বিনিয়োগের টাকা ফেরত নেওয়ার পথ খোঁজা। এই পথ খোঁজার জন্য স্টারমারের সঙ্গে ড. ইউনূসের বৈঠক হওয়া জরুরি ছিল। দুই সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সমঝোতা এবং প্রতিশ্রুতি ছাড়া পাচার করা টাকা ফেরত নেওয়া অসম্ভব।