ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পনেরো বছরের শাসনামলের তিন খলনায়ক সিইসি ছিলেন কাজী রকিবউদ্দিন, কেএম নুরুল হুদা ও কাজী হাবিবুল আউয়াল। রকিবউদ্দিন গুরুতর অসুস্থ। বারিধারার ‘জে’ ব্লকের বাসায় থাকেন। তিনি ছিলেন বিনা ভোটের কারিগর, বিনা ভোটের নির্বাচন করার জন্য পরিচিত।
বাকি দুই সাবেক সিইসি গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে জেলে আছেন। কেএম নুরুল হুদা নিশিরাতের ভোটের নির্বাচন করার জন্য পরিচিত। আর কাজী হাবিবুল আউয়াল পরিচিত ডামি নির্বাচনের জন্য। এ নির্বাচনকে আমি-ডামি নির্বাচনও বলা হয়। বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে এই তিনটি নির্বাচন এতই খারাপ ও বিতর্কিত ছিল যে, দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে এগুলো নির্বাচন ছিল না, নির্বাচনের নামে ছিল কলঙ্ক ও বড় প্রহসন। এগুলো ইতিহাসের নিকৃষ্ট তামাশা হিসেবে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। শেখ হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ছাড়া সবাই এতদিন ওই তিন বিতর্কিত নির্বাচনকে ইতিহাসের নিকৃষ্ট নির্বাচন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এখন বলছেন যাদের অধীনে নির্বাচন হয়েছে তারা স্বয়ং। অর্থাৎ সাবেক দুই সিইসি স্বীকার করছেন সে কথা।
কাজী হাবিবুল আউয়াল আদালতে দাঁড়িয়ে বিচারকের সামনে স্বীকার করেন, তার অধীনে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল একটি প্রহসনের নির্বাচন। কাঠগড়ায় তিনি একঘণ্টা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পিপির বক্তব্য শেষ হওয়ার পর কথা বলার জন্য অনুমতি চান। আদালতের অনুমতি নিয়ে তিনি বলেন, আমার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে কোনো প্রকার দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। অর্থ আত্মসাৎ করিনি। তবে আমি স্বীকার করছি, ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি ‘ডামি নির্বাচন’ হয়েছে, প্রহসনের নির্বাচন হয়েছে।
বিচারক তাকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনার সময় কেন নির্বাচনের ইনকোয়ারি কমিটির অস্বাভাবিক ভাতা বৃদ্ধি করা হয়েছিল?’ তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতিসহ নানা কারণে ভাতা বাড়ানো হয়েছিল।’ সিএমএম তাকে পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘নির্বাচনের সময় সাধারণত ভাতা ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা হয়, কিন্তু আপনার সময় (৭ জানুয়ারি, ২০২৪) ইনকোয়ারি কমিটির প্রধানদের ভাতা দেওয়া হয়েছে পাঁচ লাখ টাকা করে।’ জবাব দিতে না পেরে প্রশ্নটা এড়িয়ে যান হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলতে থাকেন, ‘১৯৭৩ সালে শেখ মুজিবের আমলের নির্বাচনেও ব্যালট পেপার ছিনতাই হয়েছিল।’ আইনজীবীরা তাকে ‘হোয়াইট কালার ক্রিমিনাল’ আখ্যায়িত করে নানা প্রশ্ন করলে একপর্যায়ে ক্ষেপে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাকে একটা রিভলবার দিয়ে গুলি করে মেরে ফেলুন।’
সাবেক সিইসি নুরুল হুদা ১ জুলাই মঙ্গলবার ঢাকার সিএমএম আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তিনি স্বীকার করেন, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন ছিল ‘নিশিরাতের ভোটের নির্বাচন’। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সরাসরি হস্তক্ষেপে দিনের ভোট রাতে করা হয়েছে। তখন গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই ও ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে পুরো নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল।
প্রায় সাত বছর আগে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের সেই ন্যক্কারজনক অনিয়মের কথা ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে তুলে ধরেন সাবেক সিইসি কেএম নুরুল হুদা। জবানবন্দি রেকর্ড করেন সিএমএম আদালতের অ্যাডিশনাল সিএমএম মো. জিয়াদুর রহমান। সাবেক সিইসি নুরুল হুদা সেদিনের সত্য ঘটনা উল্লেখ করেন বলেন, ‘আমি বলছি, তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পনা করে প্রশাসন ও পুলিশের কিছু অসৎ কর্মকর্তার যোগসাজশে ২০১৮ সালের নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপি করে দিনের ভোট আগের রাতে গ্রহণ করতে বাধ্য করে। শুধু তাই নয়, অস্বাভাবিকভাবে কোনো কোনো নির্বাচনি এলাকায় শতভাগ ভোট দেখানো হয়েছে। নির্বাচনের পর রেজাল্ট শিট দেখে জানতে পারি, অনেক কেন্দ্রে ৯০ থেকে ১০০ শতাংশ ভোট দেখানো হয়েছে। আরো শুনেছি, বেশিরভাগ কেন্দ্রেই রাতে সিল মেরে ব্যালট পেপার দিয়ে বাক্স ভর্তি করা হয়। রাতেই ভোট দেওয়া হয়ে যায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রভাবে তাদের কর্মিবাহিনী, দায়িত্বে থাকা পুলিশ, রিটার্নিং কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কমকর্তার সহযোগিতায় এই কাণ্ড ঘটেছে বলে আমি মনে করি। আর পুরো নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করেছিল গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই ও ডিজিএফআই। এ সময় ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালক ছিলেন মেজর জেনারেল (অব.) মো. সাইফুল আবেদিন এবং এনএসআইয়ের ডিজি ছিলেন মেজর জেনারেল (অব.) টিএম জুবায়ের। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনের তৎকালীন সচিব হেলাল উদ্দিন আহমেদের ভূমিকাও আমার কাছে সন্দেহজনক ছিল।
অথচ এই নুরুল হুদাই ২০১৮ সালের নির্বাচনের পরের দিন ৩১ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘নির্বাচন খুব সুষ্ঠু হয়েছে। নিশিরাতের ভোট সম্পূর্ণ অসত্য কথা।’
সাবেক সিইসি কাজী রকিবউদ্দিন সুস্থ থাকলে হয়তো তার কাছ থেকেও দেশের মানুষ জানতে পারত সেই বিনা ভোটের নির্বাচনের সত্য কথা। তিনিও হয়তো স্বীকার করতেন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন ছিল ভোটারবিহীন। ওই নির্বাচনে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কীভাবে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছিল—ভেতরের সেই কাহিনি দেশের মানুষ জানতে পারত। দেশের মানুষ মনে করে, কাজী রকিবউদ্দিন সুস্থ হয়ে মানুষকে সেই সত্য কথা তাদেরকে জানাবেন। তাহলে মানুষ তাকে ক্ষমা করেও দিতে পারে।
২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন নিয়ে ওঠা অভিযোগ তদন্ত করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত ২৬ জুন হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি শামীম হাসনাইনকে সভাপতি করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এ প্রসঙ্গে কমিটির সদস্য ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ মো. আবদুল আলীম বলেন, নুরুল হুদা কিংবা হাবিবুল আউয়াল তখন পদত্যাগ করতে পারতেন। সেটা না করে তারা তৎকালীন সরকারকে সহযোগিতা করে গেছেন। পদত্যাগ করলে আজ তারা হেনস্তার শিকার হতেন না, নায়ক থাকতেন।
এই তিনটি নির্বাচনের আগে ২০০৮ সালের নির্বাচনও ছিল বিতর্কিত। সেই বিতর্কিত নির্বাচন হয় ১/১১-র জরুরি সংস্কারের আমলে। ওই সরকারটি ছিল শেখ হাসিনার আন্দোলনের ফসল, সে কথা আওয়ামী লীগ নেত্রী নিজেই বলেছেন। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে উপস্থাপিত হয়েছে, শেখ হাসিনা মিথ্যা হলফনামা দিয়ে প্রার্থী হয়েছেন। তার প্রার্থিতা ছিল অযোগ্য, সংসদ সদস্য পদ ছিল অবৈধ, প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণ ছিল অবৈধ এবং ২০০৯ সালের সরকারও সে কারণে অবৈধ ছিল। তা ছাড়া নির্বাচনে যে ম্যানুপুলেশন হয়েছে, তাও হয়তো একদিন বের হবে। সেই নির্বাচনে বিএনপিকে ৩০ আসনে বিজয়ী দেখানো হয়। এটা তো পাগলেও বিশ্বাস করবে না। বিতর্কিত ওই নির্বাচনটি হয়েছিল বিতর্কিত সিইসি ড. এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বে। তিনি গতকাল শনিবার মারা গেছেন। তিনি সেই নির্বাচনের অভিজ্ঞতা লিখে গেছেন কি না জানি না। নির্বাচন নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, সে বিষয়ে কিছু লিখে গেলে ভালো করতেন।
দেশের মানুষ সুষ্ঠু ও সুন্দর একটি নির্বাচন থেকে দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত। আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে যে নির্বাচন হবে, সেই নির্বাচনটি তাদের মনের মতো নির্বাচন হবে, এটাই তাদের প্রত্যাশা। প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, তিনি একটি ইতিহাসসেরা সুন্দর নির্বাচন উপহার দিতে চান। সে ধরনের নির্বাচনটি হোক—এটাই সবার প্রত্যাশা।