আন্দোলনকারী ও সরকার—দুদিকের প্রচণ্ড চাপের মুখে ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান। একদিকে তার অপসারণের দাবিতে একের পর এক আন্দোলন কর্মসূচি পালন, অপরদিকে আন্দোলন সামাল দেওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বার্তা দেওয়া হয়। কিন্তু কঠোর পদক্ষেপের পরিবর্তে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে আগ্রহী ছিলেন এবং সরকারের কাছে সময়ও প্রার্থনা করেন এনবিআর চেয়ারম্যান। কিন্তু একপর্যায়ে আন্দোলন পুরো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় সরকার বাধ্য হয়ে হস্তক্ষেপ করে। এনবিআর পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়ায় সরকারের শীর্ষ মহল খুবই বিরক্ত হয় এবং এনবিআর বোর্ডের সবাইকে অপসারণের বিষয়ে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আলোচনাও হয়।
এনবিআরের বিভিন্ন সূত্র আমার দেশকে বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করে। গত ৩ মে এনবিআর বিষয়ে পাঁচ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক সদস্য আমার দেশকে বলেন, আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতায় চেয়ারম্যানসহ এনবিআরের পুরো বোর্ডই অপসারণ করতে চেয়েছিল সরকার। কিন্তু সবাইকে একসঙ্গে অপসারণ করলে এনবিআরের মতো একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় বড় ধরনের সংকট তৈরি হবে—উপদেষ্টা পরিষদের এক সদস্যের এমন বক্তব্যের কারণে শেষ পর্যন্ত ওই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সরকার।
এনবিআর আন্দোলন, অধ্যাদেশে সংশোধন এবং সার্বিক বিষয় পর্যলোচনায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবিরকে প্রধান করে পাঁচ উপদেষ্টাকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে সরকার। কমিটি পর্যায়ক্রমে বিসিএস (কর) ক্যাডার, বিসিএস (ভ্যাট ও কাস্টমস) ক্যাডার এবং চেয়ারম্যান ও বোর্ডের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করে।
সূত্র জানায়, উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে এনবিআরের কর্মকর্তাদের তীব্র ভাষায় তিরস্কার এবং কর্মকর্তাদের আচরণকে ট্রেড ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে তুলনা করা হয়।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার দেশকে জানান, দীর্ঘ দুই মাস ধরে আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার কারণে উপদেষ্টারা এনবিআর চেয়ারম্যানসহ বোর্ডের ওপর তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তবে আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে চেয়ারম্যান কেন ব্যর্থ হলেন এবং এর নেপথ্যে কারা ছিলেন, তা উদ্ঘাটনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয় বৈঠকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সংস্কার নিয়ে এনবিআরে আন্দোলন শুরু হলে এটিকে নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে এনবিআর চেয়ারম্যানকে তাগিদ দেওয়া হয়। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্যও বলা হয়। আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে আনার বিষয়ে সরকারকে আশ্বস্ত করেন চেয়ারম্যান এবং একই সঙ্গে সময় প্রার্থনাও করেন। কিন্তু নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে আন্দোলনের তীব্রতা আরো বেড়ে যায়। একপর্যায়ে তা কমপ্লিট শাটডাউনে পরিণত হয়। আর এ কর্মসূচিতে আমদানি-রপ্তানির মতো গুরুত্বপূর্ণ সেবাও বন্ধ করে দেন এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ফলে দেশের অর্থনীতি অচল হয়ে পড়ে।
নজিরবিহীনভাবে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের কমিশনার সব কার্যক্রম বন্ধ করে আন্দোলনে যোগ দিতে ঢাকায় চলে আসেন। উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মন্তব্য করা হয়—‘এটা মনে হয় বাপের দিনের আড়তদারি। কমিশনার অফিস চালু না করে আন্দোলন চালু করেছেন।’ অবশ্য ওই কমিশনারকে ইতোমধ্যে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
এদিকে সরকার বোর্ডের তিন সদস্যকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখা, আন্দোলনে দিকনির্দেশনা দেওয়া এবং আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশের কারণে তাদের অবসরে পাঠানো হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এ ছাড়া একজন কর কমিশনারকেও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত কার্যক্রম চলমান।
অপরদিকে আন্দোলনে যারা সীমা লঙ্ঘন করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান। গত মঙ্গলবার ঢাকা কাস্টমস হাউসের কার্যক্রম পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, যারা দায়িত্বশীল হয়ে কাজ করবেন তাদের ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু যারা সীমা লঙ্ঘন করেছেন, তাদের বিষয়টি ভিন্নভাবে দেখা হচ্ছে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আন্দোলনে যেসব কর্মকর্তা খুবই সক্রিয় ছিলেন, তাদের একটি তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। ফলে কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি ও আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। আন্দোলনে সক্রিয় থাকাদের কয়েকজন ইতোমধ্যে চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ক্ষমা চেয়েছেন। তারা তাদের কৃতকর্মের জন্য ভুল স্বীকার করেছেন। এনবিআর চেয়ারম্যান ব্যক্তিগতভাবে ক্ষমা করলেও বিষয়টি এখন সরকারের উচ্চ মহল থেকে মনিটরিং করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। এক্ষেত্রে চেয়ারম্যানের পক্ষে কর্মকর্তাদের ক্ষমা করার বিষয়টি কতটা ফলপ্রসূ হবে, এটি নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না। বিশেষ করে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা আন্দোলনে শালীনতার সীমা অতিক্রম করেন। তাদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারে বলে অনেকেই মনে করছেন।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, এনবিআর আন্দোলনকে স্বাভাবিক বলে মনে করছে না সরকার। রাজস্ব আহরণ এবং আমদানি-রপ্তানির মতো গুরুত্বপূর্ণ সেবা খাতের সঙ্গে জড়িত এ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনের পেছনে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল জড়িত থাকতে পারে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণছাড় এবং রাজস্ব আদায় বৃদ্ধিতে সংস্থাটির শর্তপূরণে সরকারের পক্ষ থেকে যখন নানা উদ্যোগ ও আলোচনা চলছিল, তখন এনবিআরের এ আন্দোলন কর্মসূচির কারণে সরকারকে বড় ধরনের বেকায়দায় পড়তে হয়েছিল। আইএমএফের সঙ্গে ঋণচুক্তির অন্যতম শর্তের মধ্যে এনবিআরকে ভেঙে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে দুটি পৃথক বিভাগ গঠনও রয়েছে। কিন্তু আন্দোলনকারীদের সংস্কারের বিরোধিতা এবং এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবিতে কর্মসূচির কারণে ঝামেলা হয়েছিল বলে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে জানান অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।
এনবিআর বিলুপ্ত করে দুটি পৃথক বিভাগ গঠনে গত মে মাসে অধ্যাদেশ জারির পর থেকে আন্দোলন করে আসছিল এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ। গত ২৮ জুন থেকে লাগাতর শাটডাউন কর্মসূচি পালন করে তারা। কর্মসূচির দ্বিতীয় দিন সরকারের পক্ষ থেকে আন্দোলন প্রত্যাহার করে কাজে যোগদানের আহ্বান জানানো হয়। অন্যথায় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়। একই সঙ্গে সদস্যসহ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্তের কথা জানায় দুদক। ওই দিন রাতেই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সমাঝোতা বৈঠকে আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহার করে ঐক্য পরিষদ। কর্মসূচি প্রত্যাহারের পর আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকার কারণে বিভিন্ন ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।