তৈরি পোশাক রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচার এবং হুন্ডির প্রমাণ পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এক্ষেত্রে পণ্য রপ্তানিতে প্রচলিত বাজারমূল্যের চেয়ে কম মূল্য দেখানো, প্রকৃত ওজনের চেয়ে বেশি ওজন প্রদর্শন এবং শুল্ক ফাঁকি দিতে একাধিক ইনভেয়স তৈরির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবে রপ্তানির আড়ালে এই পাচার হচ্ছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শনে এ তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। সভায় ব্যাংকগুলোকে এ বিষয়ে কঠোর বার্তা দেন তিনি।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, আমদানিকারককে আমদানি শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার সুবিধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে। অপরদিকে ক্ষেত্রবিশেষে পণ্য রপ্তানিতে আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকের যোগসাজশে প্রকৃত রপ্তানি মূল্যের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম রপ্তানিমূল্য নির্ধারণ করে তা প্রত্যাবাসন করা হয়। বাকি রপ্তানিমূল্য ইনওয়ার্ড রেমিট্যান্স হিসেবে দেশে প্রত্যাবাসন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে রেমিট্যান্স প্রণোদনার সুবিধাও পাচ্ছে।
এছাড়া বেসরকারি একটি ব্যাংকের গ্রাহকের অনুকূলে ইস্যুকৃত প্রোফর্মা ইনভয়েস অন্য একটি সরকারি ব্যাংকের গ্রাহক সেলস কন্ট্র্যাক্ট হিসেবে ব্যবহার করে পণ্য রপ্তানি করা হয়। আবার কোনো কোনো ব্যাংকের গ্রাহক যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের দেশগুলোতে স্ট্যান্ডার্ড মূল্য ও ওজনে গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি করলেও একই পণ্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে কয়েকগুণ কম মূল্যে এবং অতিমাত্রায় ওজন প্রদর্শন করে রপ্তানি করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান আমার দেশকে বলেন, বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। গভর্নর ব্যাংকগুলোকে বলেছে এ ধরনের ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে না ঘটে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কঠোর অবস্থানে রয়েছে।
আরিফ হোসেন খান আরো জানান, ডিজিটাল ব্যাংকিংকে গুরুত্ব দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে ব্যাংকগুলোকে। গ্রাহকরা যাতে অনলাইনে বা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করতে পারেন, সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। এতে গ্রাহকদের ব্যাংকের শাখায় সশরীরে যেতে হয় না, ফলে সময় ও অর্থ সাশ্রয় হয়। একই সঙ্গে এলসি দায় পরিশোধের সঙ্গেসঙ্গেই ফোর্স লোন সৃষ্টি করার কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কারণ এখন থেকে নন-ব্যাংকিং কার্যক্রম সহ্য করা হবে না।
সভায় আমদানির দায় পরিশোধের পরও কোনো কোনো ব্যাংক গ্রাহকের নামে ফোর্স লোন সৃষ্টি করছে না সেই বিষয়েও আলোচনা হয়। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে সতর্ক করা হয়েছে।
এ বিষয়ে মুখপাত্র বলেন, ব্যাংকগুলো গ্রাহকের এলসি খোলার পর যখন পেমেন্টের সময় আসে সে সময় দেখা যায় গ্রাহক তা পরিশোধ করে না। তখন ব্যাংক তা পরিশোধ করে দেয়। নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংককে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রাহকের নামে ফোর্স লোন তৈরি করতে হবে। অধিকাংশ ব্যাংক ঋণ সৃষ্টি করছে না। তাই ব্যাংকগুলোকে তাৎক্ষণিক ঋণ সৃষ্টির জন্য বাধ্য করা হয়েছে। এটা মূলত করে একক ঋণসীমা যাতে অতিক্রম না হয়।
এছাড়া সভায় জুলাই যোদ্ধা ও তাদের শহীদ পরিবারকে আর্থিক সহায়তা, দেশের মুদ্রানীতি ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, ব্যাংক কোম্পানি বহিঃনিরীক্ষা বিধিমালা, ব্যাংকার্স হাসপাতাল এবং ১০০ কোটি টাকার ওপরে খেলাপি ঋণ নিয়ে আলোচনা হয়।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত ডিসেম্বরের শেষে ১০০ কোটি টাকা ও তদূর্ধ্ব অঙ্কের খেলাপিঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এটি ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের ৫৭ শতাংশেরও বেশি। এই অঙ্কের খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ ও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মামলা পরিচালনার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই সঙ্গে এই ঋণ তদারকি ও আদায়ে ব্যাংকগুলোর গৃহীত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের অগ্রগতিও জানতে চাওয়া হয়েছে।
সভা শেষে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, জুলাই আন্দোলনে যারা জীবন দিয়েছেন তাদের জন্য একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে। এখানে বাংলাদেশ ব্যাংক ১৫ কোটি টাকা দেবে। বাকিটা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো দেবে। মোট ২৫ কোটি টাকার আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে।