ফ্যাসিবাদ শাসনামলে সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ইসলামকে টার্গেট করা হয়েছিল বলে মন্তব্য করেছেন আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান।
তিনি বলেন, অনেকে জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক বিজয়ের কথা বলছেন, এই লড়াইয়ের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল বিগত ১৬ বছরে ফ্যাসিবাদী চিন্তা-চেতনার পরিবেশের মধ্যে, তারই চূড়ান্ত বিস্ফোরণ হয়েছে জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। এটা খুব সহজ ছিল না, সে সময় সাহিত্যে নাটকে সিনেমায় তথা সাংস্কৃতিক জগতে ইসলামকে মোকাবেলার চেষ্টা করা হয়েছিল। সেখানে হিন্দু ধর্মের অনেক কিছু গ্রহণ করা হলেও ইসলামকে টার্গেট করা হয়েছিল।
মাহমুদুর রহমান বলেন, যেকোনো সাহিত্যে হিরো লাগে, জুলাই বিপ্লব আমাদেরকে আবু সাঈদ, মুগ্ধ ও আনাসের মতো অনেকগুলো হিরো দিয়েছে। আনাস যে চিঠি লিখে চলে গেছে সেটাই আজ আমাদের সাহিত্য। এক্ষেত্রে তিনি স্বদেশি আন্দোলনের কথা তুলে ধরে বলেন, স্বদেশি আন্দোলনে খুদিরাম হিরো হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল, সেসময় খুদিরাম সাহিত্যে হিরো ছিল, খুদিরামের গান জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। তেমনি জুলাই বিপ্লব আমাদেরকে অনেকগুলো হিরো দিয়েছে। তাই আজ দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হলে সাংস্কৃতিক লড়াইকে আরো শাণিত করতে হবে। এজন্য কবি-সাহিত্যিকদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
আমার দেশ সম্পাদক বলেন, আমার দেশ শুধু একটি পত্রিকা নয়, এটি একটি লড়াইয়ের হাতিয়ার। ২০০৮ সাল থেকে আমরা লড়াই করে আসছি। এই লড়াই বিদেশি সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে, বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং জনগণের অধিকারের পক্ষে। মাঝখানে পত্রিকাটি বন্ধ করে আমাদের কণ্ঠরোধ করা হয়েছিল। আবার শুরু করেছি মাত্র কয়েক মাস হলো, আমাদের লড়াই অব্যাহত আছে।
তিনি আরও বলেন, যেহেতু আমরা লড়াইয়ের কথা বলছি; এখানে বড় অংশেই লড়াইটা হচ্ছে সাংস্কৃতিক লড়াই। স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হলে সাংস্কৃতিক লড়াইকে আরো শাণিত করার বিকল্প নেই। এ লড়াইকে শাণিত করতে হলে কবি-সাহিত্যিকদের ভূমিকা প্রয়োজন। মূল কাজটি কবি-সাহিত্যিকদেরই করতে হবে এক্ষেত্রে আমরা তাদের সহায়ক হিসেবে থাকবো।
আমার দেশ সম্পাদক বলেন, বাংলা সাহিত্য আমরা যদি দেখি, দুর্ভাগ্যবশত বাঙালি মুসলমানদের চিত্র খুঁজে পাওয়া কঠিন। আমরা যাদের উপন্যাস পছন্দ করি—রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ, সমরেশ ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, কিন্তু আমরা বাঙালি মুসলমানদের খুঁজে পাই না। খুঁজে পাওয়ার যে চেষ্টা সেটা এখনো চলছে।
মাহমুদুর রহমান বলেন, আমার দেশ এমন একটা প্লাটফর্ম করতে চাই— যেখানে তরুণরা এমন সাহিত্য রচনা করবে, সেখানে বাঙালি মুসলমানদের চিত্র ফুটে উঠবে। আমাদের আশা আকাঙ্ক্ষা ও বেদনার কথা ফুটে উঠবে। আমাদের ইতিহাস- ঐতিহ্য বেশি মাত্রায় প্রতিফলিত হবে, সেটাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। যতদিন গণমাধ্যমের সঙ্গে আছি ততদিন এই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবো। এই সাহিত্য পাতার মাধ্যমে নতুন নতুন সাহিত্য সৃষ্টিতে সহায়ক হবে মনে করেন তিনি।
সংস্কৃতি ও ধর্ম রাজনীতির বাইরে নয় উল্লেখ মাহমুদুর রহমান বলেন, আমার দেশ পত্রিকায় রাজনৈতিক বিষয়গুলো প্রাধান্য পেলেও সংস্কৃতিকেও গুরুত্ব দেয়া হয়। কারণ সংস্কৃতি ও ধর্ম রাজনীতির বাইরে নয়। এজন্য রাজনীতির বাইরে ধর্ম, ফিচার ও স্বাস্থ্য এই তিনটি পাতাকে আমরা বেশি গুরুত্ব দিয়েছি।
অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক লেখক ও গবেষক ড. ওয়াকিল আহমদ বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে একটা বিস্ফোরণ হয়েছে, যেখানে স্বল্প সময়ে এতো লেখা, কবিতা ও গান রচিত হয়েছে যে আমাদের সামনে অবারিত দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছে। এগুলোকে কাজে লাগিয়ে আমাদের সাহিত্যে ব্যাপক পরিবর্তনের সুযোগ এনেছে। কিন্তু কিছু সময়ের ব্যবধানেই আমরা যেন আগের জায়গায় ফিরে যাচ্ছি।
তিনি আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে একজন বিদ্রোহী দুঃসাহসী ও নির্ভীক সংগ্রামী কলম সৈনিক হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
দৈনিক নয়া দিগন্তের সম্পাদক সালাহউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর বলেন, এই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের সংকট ও সম্ভাবনা সম্পর্কে জানতে পারলাম। সংকট উত্তরণে লেখক কবি-সাহিত্যিকদের এগিয়ে আসতে হবে। এ ধরনের অনুষ্ঠান আরো বেশি হওয়া দরকার।
আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মাঝে তার মা অধ্যাপিকা মাহমুদা বেগমের ব্যক্তিত্বের অবিকল প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই বলে মন্তব্য করেন সালাহউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর।
লেখক ও চিন্তক মুসা আল হাফিজ বলেন, শুধু শেখ হাসিনাই স্বৈরাচার ছিল না, মুনতাসির মামুনরাও স্বৈরাচার। একজনে গুলি করার অর্ডার দিয়েছে, মুনতাসির মামুনের মতো লোকেরা এটাকে বৈধতা দিয়েছে।
কবি ও চিন্তক ইমরুল হাসান বলেন, বাংলা একাডেমি, শিশু একাডেমি কিংবা জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো দখল করে নিলেই যে ন্যারেটিভ তৈরি হবে এমনটি নয়। আমাদের সাহিত্যের ভিশনটা পরিষ্কার থাকা দরকার। আর সাহিত্য চর্চার জায়গাটাও ফ্রি ফেয়ার থাকা উচিত।
কবি ও গল্পকার জহির হাসান, ক্ষমতার সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক রয়েছে। কেননা, ক্ষমতার কেন্দ্রে যারা থাকেন তারা সাহিত্য চর্চার প্রতিষ্ঠানগুলো দখল করে নিয়ে নানারকম রাজনৈতিক ন্যারেটিভ তৈরি করেন। তাই রাজনৈতিক ক্ষমতাকে যদি সঠিক ব্যবহার না করা যায় ততোদিন আমাদের সাংস্কৃতিক ন্যারেটিভও সেভাবে তৈরি হবে না।
প্রতিধ্বনি বিডি.কমের সম্পাদক কবি সাখাওয়াত টিপু বলেন, জুলাই বিপ্লবের আগে পরের সাহিত্য চর্চার ন্যারেটিভ আমাদের সামনে পরিষ্কার থাকা দরকার। তিনি আরো বলেন, ফিলিস্তিন ও কাশ্মীর সমস্যাও আমাদের সমস্যা। কেননা এসব সমস্যার সমাধান হয়ে গেলে বিশ্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার সমস্যাগুলোর অনেকটাই সমাধান হয়ে যেত।
জুলাই বিপ্লবের পর সাহিত্য জগতেও পরিবর্তন এসেছে বলে মন্তব্য করে কবি ও শিক্ষক শান্তা মারিয়া বলেন, আমরা এখানে সাহিত্য নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক করতে পারছি এবং আমার দেশ পুনরায় প্রকাশিত হয়েছে এটাও একটা পরিবর্তন। জুলাই বিপ্লবের পর সার্বিক পরিবর্তনের এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আমাদের সাহিত্যকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে।
কবি হাসান রোবায়েত বলেন, জুলাই বিপ্লবের পর সাহিত্য জগতে খুব একটা পরিবর্তন এসেছে বলে মনে করছি না। কেননা, আগে যারা সাহিত্য নিয়ে যা ভাবতেন তারা এখনো তাই ভাবছেন, আমরা হয়ত আরো বেশি করে কিছু ভাবছি। কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে কালচারাল ন্যারেটিভ খুব একটা এখনও পরিবর্তন আসেনি। তাই আমাদেরকে এ নিয়ে ভাবতে হবে।
আমার দেশ-এর সাহিত্য সম্পাদক মুহিম মাহফুজের সঞ্চালনায় এতে বক্তব্য রাখেন- দৈনিক নয়া দিগন্তের সম্পাদক সালাহউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক লেখক ও গবেষক ড. ওয়াকিল আহমদ, প্রতিধ্বনি বিডি.কমের সম্পাদক কবি সাখাওয়াত টিপু, লেখক ও চিন্তক মুসা আল হাফিজ, কবি ও চিন্তক ইমরুল হাসান, কবি ও গল্পকার জহির হাসান, কবি শাহীন রিজভী, কবি ও শিক্ষক শান্তা মারিয়া, কবি হাসান রোবায়েত, ইউনাইটেড মুসলিম উম্মাহর প্রেসিডেন্ট মজুমদার মুহাম্মদ আমিন প্রমুখ। এছাড়াও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আমার দেশ-এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক জাহেদ চৌধুরী, সহযোগী সম্পাদক আলফাজ আনাম ও কবি রায়হান আহমেদ তামীম।