উল্কার গতিতে তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলেন। আগ্রাসী ভারত ও তার আওয়ামী সহযোগীদের নিবর্তনমূলক শাসন ধারার বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলেছিলেন। মধ্য, বাম, ডানসহ সব মত-পথের সমন্বয় ঘটিয়ে তিনি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের যে ভিত্তি রচনা করেছিলেন, তা আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল, যা এখনো আমরা অনুভব করি গভীরভাবে। গত জুলাই বিপ্লবে ভারতের আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে ছাত্রজনতার যে বিস্ফোরণ ঘটেছিল, তা মূলত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির অন্তর্নিহিত চেতনা থেকেই উৎসারিত হয়েছিল।
তিনি ছিলেন একদিকে বীর মুক্তিযোদ্ধা, সমরবিদ, রাজনীতিক, রাষ্ট্রনায়ক; অন্যদিকে একজন সফল সংস্কারক। ক্ষণজন্মা এই মহান রাষ্ট্রনায়ক হচ্ছেন, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তার সততা ও অসাধারণ দেশপ্রেমের নজির তিনি নিজেই। তার শাহাদতবরণের পর ৪৪ বছর কেটে গেছে; কিন্তু তার সমকক্ষ কোনো রাজনীতিবিদের আবির্ভাব আর বাংলাদেশে ঘটেনি। তিনি নিজেই নিজের দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন।
তবে এ সত্য অস্বীকার করা যাবে না যে, তার স্ত্রী, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া স্বামীর রাজনীতির ধারা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করে গেছেন আন্তরিকভাবে। তিনিই জিয়াউর রহমানের সমন্বয়ের রাজনীতি অব্যাহত রেখেছিলেন সমমনাদের নিয়ে একের পর এক জোট গঠনের মধ্য দিয়ে। সামরিক শাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি গঠন করেছিলেন সাতদলীয় জোট। এরপর চারদলীয় জোট এবং সবশেষে শেখ হাসিনার নিপীড়নমূলক শাসনের বিরুদ্ধে ২০ দলীয় জোট গঠন করেছিলেন। শত প্রতিকূলতা, শত প্রতিবন্ধকতা ও শত অপপ্রচার সত্ত্বেও বেগম খালেদা জিয়া কখনোই জিয়াউর রহমানের সমন্বয়ের রাজনীতি থেকে সামান্যতম বিচ্যুত হননি।
একটা রক্তাক্ত যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন প্রয়োজন ছিল সব দলমত ও পথকে একত্র করে দেশ পুনর্গঠনে উদ্যোগ গ্রহণ করা, তখন আওয়ামী লীগ সবকিছু অবজ্ঞা করে এককভাবে সরকার গঠন ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার যে নীতি গ্রহণ করেছিল, তা দেশকে চরমভাবে বিভক্ত করে ফেলেছিল। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সেটা গভীরভাবে উপলব্ধি করে একটি সমন্বয়ের রাজনীতির সূচনা করেছিলেন। সেই রাজনীতির ফলে একাত্তরে নিন্দিত ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও মুসলিম লীগ নেতা খানে সবুর ১৯৭৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনটি আসনে বিজয়ী হয়ে পার্লামেন্ট এসেছিলেন। একইভাবে নিন্দিত ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও শাহ আজিজুর রহমানকে জিয়াউর রহমান প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন। তখন অনেকেই ভেবেছিলেন, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সভাপতি মশিউর রহমান যাদু মিয়াকে প্রধানমন্ত্রী করা হবে। কিন্তু জাতীয় ঐক্য গঠনের স্বার্থে জিয়াউর রহমান তা করেননি। যাদু মিয়াকে সিনিয়র মন্ত্রী করে সন্তুষ্ট রেখেছিলেন।
এখানেই শেষ নয়, দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান আরো বৃহত্তর আঙ্গিকে মূল্যায়ন করে একাত্তরের ভূমিকার কারণে নাগরিকত্ব হারানো জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযমকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তারপর তিনি আদালতের রায়ের মাধ্যমে নাগরিকত্ব ফেরত পেয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী নেতা মাওলানা আব্দুর রহিমের নেতৃত্বে গঠিত ‘ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ’ নামে একটি জোটের ব্যানারে জামায়াতে ইসলামীকে নির্বাচন করার সুযোগও করে দেওয়া হয়েছিল। অন্যান্য ইসলামি দলগুলো এই জোটের মাধ্যমে নির্বাচন করার সুযোগ লাভ করে। ওই নির্বাচনে এই জোট ছয়টি আসনে বিজয় লাভ করেছিল। আরো মজার ব্যাপার ছিল, যারা ’৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই যুদ্ধকে ‘দুই কুকুরের লড়াই’ বলে অভিহিত করেছিলেন, সেই কমিউনিস্টদের নেতা মোহাম্মদ তোয়াহাকেও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দিয়ে পুনর্বাসিত করেছিলেন।
অথচ ১৯৭২-৭৫ আওয়ামী শাসন আমলে ইসলামি দলসহ কমিউনিস্ট আন্ডারগ্রাউন্ড দলগুলোর রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। বিশেষ করে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইসলামি দলগুলোর জাতীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে চারদলীয় জোট গঠিত হয়। সেই জোটে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্য জোট নামে দুটি ইসলামি দল ছিল। পরবর্তী সময়ে বেগম খালেদা জিয়া এই জোটকে আরো সম্প্রসারণ করেছিলেন, কার্যত যা শেষতক ২০ দলীয় জোটে পরিণত হয়। এটা ছিল বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে জিয়াউর রহমানের রাজনীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখার এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
আজ খালেদা জিয়া অসুস্থ। সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে আছেন। তিনি আর আগের মতো সামনে থেকে দলকে নেতৃত্ব দিতে পারছেন না। তাই কোথায় যেন বিএনপির রাজনীতির একটি ছন্দপতন পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষ করে গত ১৫ জুলাই বিএনপি মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত সমাবেশসহ সাম্প্রতিক বেশ কিছু সমাবেশ ও মিছিলের স্লোগান শুনে মনে হয়েছে, কোথাও যেন দলটির রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা, বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য ইসলামি দল থেকে একটা দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করছে। হতে পারে এটা ভোটের রাজনীতির কৌশল, যেমন করে ২০০১ সালের নির্বাচনে চারদলীয় জোট করে বিএনপি বিশাল বিজয় লাভ করেছিল। সেটা ছিল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একটি নিখুঁত ভোটের হিসাব। সে কারণে সেই নির্বাচনে চারদলীয় জোট দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়লাভ করেছিল। হতে পারে বর্তমানে বিএনপি এ ধরনের একটা হিসাব থেকে অতীতের রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা থেকে বেরিয়ে এসেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদ ও ইসলামি মূল্যবোধের পথ পরিহার করে হয়তো নতুন কোনো মেরূকরণ করার চেষ্টা করছে। তবে ভবিষ্যতে জানে, এই নতুন রাজনীতির সাফল্য কতটা বিএনপির ঘরে আসবে?