প্রত্যেক জাতির উন্নতি নির্ভর করে তরুণ প্রজন্মের ওপর। নবীনরা সমাজের প্রাণশক্তি, পরিবর্তনের চালিকাশক্তি এবং ভবিষ্যতের স্থপতি। আর প্রবীণরা হলেন অভিজ্ঞতার বাতিঘর। নবীনদের হাত ধরে সমাজ গঠিত হয়, আর প্রবীণদের অভিজ্ঞতা সেই সমাজকে পথ দেখায়। কিন্তু একে অপরকে বিশ্বাস না করলে সেই সমাজে ভারসাম্য নষ্ট হয়।
ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে নবীনদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা কেবল সামাজিক দায়িত্ব নয়, বরং এটি একটি ঈমানি দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনের মধ্যে রয়েছে সওয়াব, বরকত ও ভবিষ্যৎ গঠনের নিশ্চয়তা।
ইসলামে তরুণদের মর্যাদা ও গুরুত্ব
ইসলামের ইতিহাসে নবীনদের ভূমিকা অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল। মহানবী (সা.) নবীনদের প্রতি অপরিসীম আস্থা রেখেছেন। ১৭ বছর বয়সি উসামা ইবনে জায়দ (রা.)-কে তিনি বিশাল বাহিনীর সেনাপতি নিযুক্ত করেছিলেন। মুসআব ইবনে উমাইর (রা.)-কে মদিনার প্রথম দাই হিসেবে পাঠানো হয়। আলি (রা.) ছিলেন ইসলামের প্রথম দিককার তরুণ সাহাবিদের অন্যতম, যিনি ছোট বয়সেই রাসুলের (সা.) পাশে থেকে ইসলাম রক্ষায় সাহসিকতা দেখিয়েছেন। এগুলো কেবল ইতিহাস নয়, বরং নবীনদের প্রতি গভীর আস্থার বাস্তব দৃষ্টান্ত। নবীজি (সা.) বুঝতেন, তরুণদের হাতে দায়িত্ব না দিলে তারা কখনোই পরিপক্বতা অর্জন করতে পারবে না।
আস্থা ঈমানের পরিচায়ক
ঈমান কেবল নামাজ-রোজা নয়, বরং মানবিক দায়িত্ব ও পারস্পরিক আস্থার মধ্যেও ঈমানের প্রতিফলন ঘটে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা কেউই পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে নিজের জন্য যা চায়, তা-ই তার ভাইয়ের জন্যও চায়।’ (বুখারি ও মুসলিম)
এই হাদিসের আলোকে আমরা যদি তরুণদের জন্য উন্নতি, পথনির্দেশ, সুযোগ ও মর্যাদা না চাই, তবে আমরা আমাদের ঈমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত পূরণ করছি না। তরুণদের ভুলত্রুটি হতে পারে, কিন্তু বিশ্বাস স্থাপন মানে হলো—তাদের শেখার সুযোগ দেওয়া এবং ধৈর্যের সঙ্গে সহানুভূতির হাত বাড়ানো।
বর্তমান বাস্তবতায় তরুণদের প্রতি মনোভাব
আজকের সমাজে একটি উদ্বেগজনক চিত্র দেখা যায়—তরুণদের অবজ্ঞা করা হয়, তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না এবং তাদের চিন্তাকে ‘অভিজ্ঞতার অভাব’ বলে খাটো করা হয়। অনেক প্রবীণ বলেন, ‘তোমরা এখনো কাঁচা’, ‘দায়িত্ব নেওয়ার বয়স হয়নি’, প্রভৃতি। অথচ এই মনোভাব তরুণদের আত্মবিশ্বাস ভেঙে দেয়। একটি জাতির ভবিষ্যৎ তখনই অন্ধকার হয়ে পড়ে, যখন সে তার ভবিষ্যৎ নির্মাতাদের ওপর আস্থা রাখতে ব্যর্থ হয়।
ঈমানি দায়িত্ব হিসেবে নবীনদের মূল্যায়ন
ইসলামে দায়িত্ব বণ্টনের সময় বয়সের চেয়ে যোগ্যতা ও মননশীলতা বড় বিষয়। রাসুল (সা.) নিজে একাধিকবার তরুণদের বড় বড় দায়িত্ব দিয়েছেন। আমাদেরও উচিত তরুণদের চিন্তা ও উদ্যোগকে গুরুত্ব দেওয়া, তাদের ভুল সংশোধনের সুযোগ দেওয়া, ভালো কাজের জন্য উৎসাহ ও প্রশংসা করা এবং সর্বোপরি সবসময় তাদের জন্য দোয়া করা। এই চারটি কাজ ঈমানেরই অংশ। কারণ এতে রয়েছে মানুষ গড়ার চেষ্টায় অংশগ্রহণ এবং আল্লাহর রাসুলের আদর্শ অনুসরণ।
ভয় নয়, আস্থা হোক ভিত্তি
প্রবীণরা অনেক সময় বলেন, ‘যদি তরুণরা ব্যর্থ হয়?’ কিন্তু প্রশ্ন হলো, তারা না শিখলে সফল হবে কীভাবে? ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ না দিলে কেউ পরিপক্ব হতে পারে না। নবীজি (সা.)-এর জীবনে আমরা দেখতে পাই, তিনি সাহাবিদের ভুলকে ক্ষমা করতেন, সংশোধনের সুযোগ দিতেন এবং আগামীর জন্য প্রস্তুত করতেন। সুতরাং আমাদের উচিত ব্যর্থতার ভয় নয়, বরং আস্থা ও ভালোবাসার মাধ্যমে তরুণদের গড়ে তোলা।
তারুণ্যের প্রতি সমাজ ও রাষ্ট্রের করণীয়
১. পরিবারে : সন্তানের প্রতি অতিরিক্ত শাসন নয়, বরং আস্থা ও আলাপের পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
২. বিদ্যালয় ও মাদরাসায় : শিক্ষকেরা যেন ছাত্রদের প্রশ্ন করার স্বাধীনতা দেন এবং তাদের নেতৃত্বগুণ বিকশিত করতে সহায়তা করেন।
৩. সমাজে : যুবকদের সামাজিক উদ্যোগ ও চিন্তাকে গুরুত্ব দিতে হবে।
৪. ধর্মীয় ক্ষেত্রে : তরুণদের ইসলামি জ্ঞানচর্চা ও দাওয়াতি কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে।
৫. রাষ্ট্রীয়ভাবে : তরুণদের অংশগ্রহণে নীতিনির্ধারণী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
ইতিহাস থেকে প্রেরণা
খলিফা ওমর (রা.) তাঁর মজলিসে যুবকদের অংশগ্রহণের সুযোগ দিতেন, কারণ তারা ছিল চিন্তাশীল ও উদ্যমী। সালাহউদ্দিন আইয়ুবি তাঁর সেনাবাহিনীতে তরুণদের ওপর আস্থা রেখেছিলেন, যারা জেরুজালেম পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও তরুণদের সাহস, আত্মত্যাগ ও নেতৃত্ব ছিল অবিস্মরণীয়। এগুলো প্রমাণ করে—যেখানে তরুণদের ওপর আস্থা রাখা হয়, সেখানেই সাফল্য ও সম্মান আসে।
পরিশেষে বলতে চাই, নবীনদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা শুধু সামাজিক বা পারিবারিক দায়িত্ব নয়; এটি একটি পূর্ণাঙ্গ ঈমানি দায়িত্ব। যারা তরুণদের ছোট করে দেখে, তারা ভবিষ্যৎকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়। আর যারা আস্থা রাখে, তারা আলোকিত ভবিষ্যৎ নির্মাণ করে। আসুন, আমরা আমাদের সমাজে একটি আস্থাভিত্তিক সংস্কৃতি গড়ে তুলি—যেখানে তরুণরা ভুল করার সুযোগ পাবে, শেখার সুযোগ পাবে, নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত হবে। এটাই ইসলামি আদর্শ। এটাই ঈমানের দাবি।