সাবেক সেনাপ্রধান ইকবাল করিম ভূঁইয়া লিখেছেন, র্যাবে কর্মরত থাকার সময় মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান কীভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। তার ফেসবুক পোস্টে তিনি উল্লেখ করেন, “বিজিবি, র্যাব, এসএসএফ ও আনসার নিয়ে আমার অভিজ্ঞতার আলোকে, র্যাব-এ প্রেষণে থাকা আমাদের অফিসারদের দ্বারা সাধারণ নাগরিক, রাজনৈতিক কর্মী বা সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের অপহরণ ও হত্যা আমাকে সবচেয়ে বেশি পীড়া দিত।”
তিনি জানান, তরুণ ও ক্যারিয়ারমুখী অফিসাররা র্যাবে কাজ শুরু করে এমন এক চরিত্র নিয়ে ফিরে আসতেন যেন তারা পেশাদার খুনি। এই প্রবণতা জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার (জেসিও), নন-কমিশন্ড অফিসার (এনসিও) ও সৈনিকদের মধ্যেও লক্ষ্য করা গেছে। সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি চেষ্টা করেছিলেন তাদের সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে আনা হোক, এবং প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টি জানান। প্রধানমন্ত্রীও কিছুটা সমর্থন দিয়েছেন, তবে বাস্তবে কার্যকর কিছু হয়নি।
ইকবাল করিম জানান, পরে কর্নেল মুজিবকে—যিনি তখন র্যাবের এডিজি ছিলেন—জিয়াউল আহসানকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে বলা হয়। কিছুদিন পরে তিনি লক্ষ্য করেন ক্রসফায়ারের ঘটনা বন্ধ আছে, তবে পরবর্তীতে বোঝা যায়, ঘটনা এখনও ঘটছে কিন্তু সংবাদ চাপা দেওয়া হচ্ছে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়, যখন কর্নেল মুজিব র্যাব ছেড়ে অন্যত্র বদলি হন এবং জিয়াউল আহসান নতুন এডিজি হিসেবে দায়িত্ব নেন।
আর্মি নিরাপত্তা ইউনিট সূত্রে জানা যায়, জিয়াউল নিজের আবাসিক টাওয়ারে গার্ড রাখতেন, বাসায় অস্ত্র রাখতেন এবং পুরো ফ্ল্যাটে সিসিটিভি বসাতেন। তাকে সতর্ক করা হলেও তার আচরণ উচ্ছৃঙ্খল থেকে যায়। ডাইরেক্টর মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বোঝানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
ইকবাল করিম আরও লিখেছেন, তিনি ঢাকা সেনানিবাসের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় জিয়াউল আহসানকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল তারিক সিদ্দিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকায় জিয়াউল তখন নির্দেশ চ্যালেঞ্জ করা শুরু করেন।
জিয়াউল আহসানের চাকরিজীবন সম্পর্কে জানা যায়, তিনি সেনাবাহিনীর ২৪তম লং কোর্সের কর্মকর্তা, পরিচিতি নম্বর বিএ-৪০৬০। ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত বাংলাদেশে সংঘটিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, নজরদারি ইত্যাদির অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত ব্যক্তি ছিলেন তিনি। তিনি ২০০৯ সালে র্যাব-২-এ যোগদান করেন, পরে র্যাব সদর দপ্তরে গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হন। ২০১৩ সালে অতিরিক্ত মহাপরিচালক এবং ২০১৫ সালে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে পদোন্নতি পান। পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই ও ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
গুম কমিশনের প্রতিবেদনে জানা যায়, জিয়াউল আহসান ও তার টিম গুম ও হত্যাকাণ্ডে সক্রিয় ছিলেন, গুমের শিকার ১,০৩০ জন। পোস্তগোলা ঘাটসহ বিভিন্ন স্থান নীরব সাক্ষী হয়ে আছে।
মোটের ওপর, বরখাস্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান ছিলেন শেখ হাসিনার শাসনকালে এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম, যিনি অপহরণ, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর নজরদারির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সাবেক সেনাপ্রধান ইকবাল করিম ভূঁইয়ার বর্ণনা অনুযায়ী, জিয়াউলের দমনাত্মক কর্মকাণ্ডের কারণে সেনাপ্রধানও আতঙ্কিত ছিলেন।