আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে বিচারিক (জুডিশিয়াল) হত্যাকাণ্ডের নির্দেশনা দিয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)। ট্রাইব্যুনালে আল্লামা সাঈদীকে জুডিশিয়াল কিলিং নিশ্চিত করতে রায় দিয়েছিলেন এটিএম ফজলে কবীর, জাহাঙ্গীর হোসেন ও আনোয়ারুল হক। এই তিন বিচারকের দেওয়া রায়ে আল্লামা সাঈদীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।
জনরোষের ভয়ে পরে আপিল বিভাগে বিভক্ত রায়ের মাধ্যমে আজীবন কারাগারে রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করেছিল ফ্যাসিবাদী সরকার। কারণ, ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর বিক্ষোভে ফুঁসে উঠেছিল সারা দেশ। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পুলিশ বাহিনী তখন নির্বিচারে গুলি চালিয়ে একদিনে দেড় শতাধিক মানুষকে হত্যা করেছিল। সরকার আপিল বিভাগের ফরমায়েশি রায়ে আল্লামা সাঈদীকে আজীবন কারাগারে রাখার ব্যবস্থা করে।
আপিল শুনানি করে চূড়ান্ত রায় দেওয়া হয় ২০১৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ আজীবন কারাগারে রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করে। বেঞ্চের অপর চার বিচারপতি হলেনÑসুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহা, মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী এবং এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। আবদুল ওয়াহহাব মিঞা বিভক্ত রায়ে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাইদীকে বেকসুর খালাস দিয়েছিলেন। শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন।
পরে আল্লামা সাঈদীর পক্ষ থেকে রিভিউ পিটিশন করা হয়েছিল। রিভিউ পিটিশন যখন শুনানি হয়, তখন প্রধান বিচারপতি ছিলেন সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। বেঞ্চের অপর বিচারপতিরা হলেনÑমো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী এবং মির্জা হোসাইন হায়দার। শামসুদ্দিন মানিক তখন অবসরে চলে যান।
আল্লামা সাঈদীর পক্ষে আপিল ও রিভিউ পিটিশন শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এসএম শাজাহান। তিনি আমার দেশকে জানান, মামলাটি যে সাজানো হয়েছিল, সে বিষয়গুলো আপিল ও রিভিউÑউভয় শুনানিতে স্পষ্ট করা হয়েছিল। কিন্তু আসামিপক্ষের কোনো তথ্য-উপাত্ত ও যুক্তিকেই গ্রাহ্য করা হয়নি। এমনকি ইব্রাহিম কুট্টি হত্যা মামলায় তার স্ত্রীর করা মামলাটি আপিল বিভাগের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছিল। তখন তদন্তের জন্য অ্যাটর্নি জেনারেল নিজে পিরোজপুর আদালতে গিয়ে পরীক্ষা করেন, তারপরও কোনো কাজ হয়নি।
পরিকল্পিতভাবে সাজানো মামলায় সাক্ষীদের বয়স, অভিযোগে উল্লিখিত ঘটনার স্থান ও সময় নিয়ে ছিল বিভ্রান্তি। যদিও বিচারের চিরন্তন নীতি অনুযায়ী অভিযোগ সন্দেহাতীত প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত চূড়ান্ত দণ্ড দেওয়া যায় না। আল্লামা সাঈদীর মামলায় ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদণ্ড ও আপিল বিভাগের আজীবন কারাদণ্ড দেওয়া দুটি অভিযোগের কেস স্টাডি পর্যালোচনা এবং স্কাইপ কেলেঙ্কারিতে প্রকাশিত নিজামুল হক নাসিমের বক্তব্য পর্যালোচনা করলেই ‘জুডিশিয়াল কিলিংয়ের’ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়।
পরিকল্পিতভাবে সাজানো মামলায় ২০টি অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। এর মধ্যে ট্রাইব্যুনাল শুধু প্রসিকিউশনের বক্তব্যকে আমলে নিয়ে আটটি অভিযোগ প্রমাণিত দেখিয়ে রায় দেয়। দুটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড এবং বাকি ছয়টি অভিযোগে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয় রায়ে। আপিল বিভাগও এ দুটি অভিযোগ আমলে নিয়ে আজীবন কারাগারে রাখার নির্দেশ দেয়। মৃত্যুদণ্ড দেওয়া দুটি অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান করে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করলেই স্পষ্ট হয়ে যায় বিচারটি ছিল সাজানো। স্কাইপ কেলেঙ্কারিতে প্রকাশিত নিজামুল হক নাসিমের বক্তব্য অনুযায়ী, রায় ছিল পূর্বনির্ধারিত। এমনকি আল্লামা সাঈদীর মামলাটি সবার আগে রায় দেওয়ার প্রক্রিয়াও চূড়ান্ত করেছিলেন নিজামুল হক নাসিম। রায়ের একটি খসড়া বেলজিয়াম থেকে আহমদ জিয়াউদ্দিনের টিম লিখে পাঠিয়ে দিয়েছিল।
কী ছিল মৃত্যুদণ্ড দেওয়া ৮ ও ১০ নম্বর অভিযোগে
৮ নম্বর অভিযোগের বর্ণনায় প্রসিকিউশনের সাজানো বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়, ‘১৯৭১ সালের ৮ মে, বেলা ৩টার ঘটনা। ঘটনাস্থল পিরোজপুরের সদর থানার চিতলিয়া গ্রামে মানিক পশারীর বাড়ি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা চিতলিয়া গ্রামে মানিক পশারীর বাড়িতে অভিযান চালায়। সেখানে নেতৃত্ব দেন আল্লামা সাঈদী। ঘটনাস্থল থেকে মফিজউদ্দিন ও ইব্রাহিম কুট্টিসহ দুজনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। পেট্রল ঢেলে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় পাঁচটি বাড়ি।’
প্রসিকিউশনের বক্তব্য অনুযায়ী, ‘মফিজ উদ্দিন ও ইব্রাহিম কুট্টিকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় আল্লামা সাঈদী প্ররোচনা দেন পাকিস্তানি সেনাদের। ঘটনাস্থল থেকে সেনারা ক্যাম্পে ফেরার পথে ব্রিজের কাছে ইব্রাহিম কুট্টিকে হত্যা করে। এ হত্যাকাণ্ডেও আল্লামা সাঈদীর প্ররোচনা ছিল। মফিজ উদ্দিনকে ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। একই দিনে পারেরহাট বন্দরে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।’ এই হচ্ছে ৮ নম্বর অভিযোগের সারসংক্ষেপ।
১০ নম্বর অভিযোগে বলা হয়, ‘১৯৭১ সালের ২ জুন, সকাল ১০টার ঘটনা। ইন্দুরকানি থানার উমেদপুর গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের ২৫টির মতো ঘর জ্বালিয়ে দেয় হামলাকারীরা। এই ঘটনায়ও নেতৃত্ব দেন আল্লামা সাঈদী। এ সময় হিন্দুপাড়ার বিশা বালীকে বাড়ির পেছনে নারকেল গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়।’ অভিযোগের বর্ণনা অনুযায়ী, ‘বিশা বালীকে নির্যাতনেও আল্লামা সাঈদীর প্ররোচনা ছিল।’
ইব্রাহিম কুট্টি হত্যা, স্ত্রীর ও মানিক পাসারির মামলা
আল্লামা সাঈদীকে অভিযুক্ত করে ইব্রাহিম কুট্টি হত্যা মামলা করা হয় ২০১০ সালে। মামলার বাদী মানিক পশারী। এ মামলায় ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপিত প্রসিকিউশনের সাক্ষী তালিকায় (পিডব্লিউ) তার নাম ছিল ৬ নম্বরে। মানিক পশারী এজাহার করেন পিরোজপুর থানায়। ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় বর্ণিত ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে দাবি করেন মানিক পশারী। অথচ প্রসিকিউশনের সাক্ষী পিডব্লিউ-১০ এবং পিডব্লিউ-১১ জেরার জবাবে জানান, ঘটনার সময় মানিক পশারী বাড়িতে ছিলেন না। ঘটনার আগেই তিনি তার পরিবারের সদস্যসহ বাড়ি ছেড়ে চলে যান।
এখানে একটি বিষয় স্পষ্টÑএজাহারের বাদী মানিক পশারী নিজেকে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করছেন। অথচ, সরকারপক্ষের ১০ ও ১১ নম্বর সাক্ষীর দাবি করেছেন, মানিক পশারী প্রত্যক্ষদর্শী নন।
ঘটনার সময় নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। এই চার্জ বা অভিযোগে বর্ণনা করা হয়, ঘটনাটি সংঘটিত হয় বেলা ৩টায়। অথচ (সরকারপক্ষের সাক্ষী) পিডব্লিউ-২ এবং পিডব্লিউ-৭-এর বর্ণনায় বলা হয়, ঘটনা ঘটেছিল সকাল ১০টা থেকে বেলা ১১টার মধ্যে। মানিক পশারী (এজাহারকারী) ইব্রাহিম কুট্টির নিকটাত্মীয়ও নন।
স্ত্রীর করা মামলা
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হয় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণ করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ইব্রাহিম কুট্টি হত্যার অভিযোগে ১৯৭২ সালে একটি মামলা হয়। মামলার বাদী ছিলেন ইব্রাহিম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম। ইব্রাহিম কুট্টির অনাত্মীয় মানিক পশারী, এজাহার করেন ২০১০ সালে। অথচ ১৯৭২ সালেই খোদ ইব্রাহিম কুট্টির স্ত্রী মমতাজ বেগম এজাহার করেছিলেন। দুটি এজাহারে সময়ের ব্যবধান প্রায় ৪০ বছর। আইনজীবীদের প্রশ্নÑএর মধ্যে কোনটা সঠিক এজাহার? ৪০ বছর পর ভিকটিমের অনাত্মীয় মানিক পশারীর করা এজাহার নাকি ঘটনার এক বছর পর ভিকটিমের স্ত্রীর করা এজাহার?
ইব্রাহিম কুট্টির (ভিকটিম) স্ত্রী মমতাজ বেগমের এজাহারের বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়, ১৯৭১ সালের ১ অক্টোবর ঘটেছিল এই ঘটনা। স্ত্রীর মামলায় বর্ণনায় উঠে আসে, ওই দিন এজাহারে উল্লেখিত আসামিরা নলবুনিয়ার বাড়িতে হামলা চালায়। ঘটনার সময় নলবুনিয়ার বাড়িতেই হত্যা করা হয় ইব্রাহিম কুট্টিকে। হত্যাকারীরা যাওয়ার সময় লাশ পারেরহাটে নিয়ে যায়। ঘটনাস্থল থেকে ইব্রাহিম কুট্টির ভাই সাহেব আলী ওরফে সিরাজ এবং তার মাকে আটক করে নিয়ে যায় হামলাকারীরা। তাদের নেওয়া হয় পিরোজপুরে পাকিস্তান আর্মি ক্যাম্পে। একপর্যায়ে ক্যাম্প থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় ইব্রাহিম কুট্টির মাকে। কিন্তু সাহেব আলীর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
ইব্রাহিম কুট্টির স্ত্রীর করা মামলার এজাহারে ঘটনার সঙ্গে জড়িত ১৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। তারা সবাই স্থানীয় রাজাকার বা পাকিস্তান আর্মির সহযোগী। ১৯৭২ সালের শেখ মুজিব আমলে এজাহারটি গ্রহণের পর ঘটনার তদন্ত করে থানা কর্তৃপক্ষ। এই তদন্ত করেছে স্বাধীন বাংলাদেশের পুলিশ। এটা বলার সুযোগ নেই, তখন ক্ষমতায় ছিল বৈরী সরকার। তাই সঠিক তদন্ত সম্ভব হয়নি। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের গঠিত ও শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে তখন। শেখ মুজিব আমলে তদন্ত শেষে আদালতে অভিযোগপত্র বা চার্জশিট দাখিল করা হয়। কিন্তু ওই এজাহার বা অভিযোগপত্রে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর নাম তো ছিলই না, বরং তার প্রতি ইঙ্গিতপূর্ণ কোনো শব্দও নেই। আল্লামা সাঈদীর কোনো ধরনের সম্পৃক্ততার স্পর্শও পাওয়া যায় না এজাহার বা তদন্ত প্রতিবেদনে।
এখানে দুটি বিষয় স্পষ্ট, একটি ইব্রাহিম কুট্টির স্ত্রীর এজাহারে বলা হয়েছে, নলবুনিয়ার বাড়িতেই হত্যাকাণ্ড ঘটে। হামলাকারীরা লাশ নিয়ে যায় পারেরহাটে। অন্যটিতে মানিক পশারীর এজাহারে বর্ণিত ঘটনায় বলা হয়, ইব্রাহিম কুট্টিসহ দুই ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তান আর্মিরা। ক্যাম্পে যাওয়ার পথে ব্রিজের নিচে হত্যা করা হয় তাকে। এ হামলা ও হত্যাকাণ্ডে আল্লামা সাঈদী নেতৃত্ব দেন। ইব্রাহিম কুট্টি হত্যার ঘটনাস্থল কোনটি সত্য?
আল্লামা সাঈদীর পক্ষ থেকে কি বিষয়গুলো ট্রাইব্যুনাল বা আপিল বিভাগে উপস্থাপন করা হয়েছিল। ১৯৭২ সালের এজাহার, চার্জশিট এবং মমতাজ বেগমের করা মামলার নথির সার্টিফাইড কপি আল্লামা সাঈদীর পক্ষে ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল এগুলোকে পাত্তা দেয়নি। পরে আপিল বিভাগে বিষয়টি উত্থাপন করা হয়েছিল। তখন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম নিজে পিরোজপুর আদালতে গিয়ে সার্টিফায়েড কপিগুলোর সত্যতা যাচাই করেছিলেন। তারপরও পূর্বনির্ধারিত সরকারি ফরমায়েশি রায়ে এই অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। পরে আপিল বিভাগের অনুগত বিচারকরাও আজীবন কারাদণ্ড দেন।
চার্জ ১০, বিশা বালী হত্যাকাণ্ড
এই মামলার পিডবব্লিউ-১ মাহবুবুল আলম হাওলাদারের জবানবন্দিতে দাবি করা হয়, জনৈক খলিলুর রহমানের মাধ্যমে একটি খবর পান তিনি। ২ জুন পাকিস্তান আর্মিরা পিডব্লিউ-১-এর বাড়িতে যাবে। বিষয়টি তাকে সকালবেলায় অবহিত করা হয়। অথচ সাক্ষ্য-প্রমাণ এবং আদালতে উপস্থাপন করা ডকুমেন্টসে দেখা যায়, ওই খলিলুর রহমানের জন্ম ১৯৭২ সালে। তিনি হাসিনা একাডেমিতে চাকরি করেন। তখনই প্রশ্ন উঠেছিল ১৯৭২ সালে যার জন্ম তাকে ১৯৭১ সালের ২ জুন কীভাবে অবহিত করা হয়েছিল? প্রসিকিউশনের বর্ণনায় মুক্তিযুদ্ধের সময় মাহবুবুল আলম হাওলাদারের বয়স ১৯ বা ২০ ছিল মর্মে উল্লেখ করা হয়। আবার পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন কার্ড অনুযায়ী মাহবুবুল আলম হাওলাদারের বয়স ওই সময় ছিল ১০ বা ১১ বছর। তার জেরার সময়ও স্বীকার করেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় (১৯৭১ সালে) ছাত্র ছিলেন। কিন্তু, কোন ক্লাসের ছাত্র ছিলেন, সেটা সঠিকভাবে বলতে পারেননি। আদালতে উপস্থাপন করা প্রদর্শনী হতে দেখা যায়, তার বড় বোন মাতোয়ারা বেগমের জন্ম ১৯৫৭ সালে। সে ক্ষেত্রে মাহবুবের জন্ম তার বড় বোনের আগে হওয়ার কোনো কারণ নেই। তার সার্টিফিকেট অনুযায়ী ১৯৭৬ সালে এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স কত ছিল এতেই অনুমান করা যায়।
পিডব্লিউ-৫ মাহতাবের ক্ষেত্রেও আদালতে উপস্থাপন করা প্রদর্শনী অনুযায়ী জন্ম তারিখ এ রকমই দেখা যায়। সুতরাং ১৯৭১ সালে তাদের বয়স ছিল সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১১ বছর।
হত্যাকাণ্ডের স্থান নিয়ে ছিল ভিন্নমত
মামলার অভিযোগে বলা হয়, বিশা বালীকে হত্যা করা হয় উমেদপুরে। অথচ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, নিহত বিশা বালীকে উমেদপুর থেকে কয়েক মাইল দূরে বলেশ্বর নদীর ঘাটে হত্যা করা হয়েছিল। এ বিষয়ে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের একটি প্রতিবেদন রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ হচ্ছে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠন। তাদের রিপোর্ট বিশ্বাসযোগ্য নাকি ঘটনার ৪০ বছর পর সাজানো মামলায় বর্ণিত বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য? এই চার্জের পক্ষে প্রসিকিউশনের সাক্ষী পিডব্লিউ-১ এবং পিডব্লিউ-২৮ জেরায় আদালতে স্বীকারও করেছেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রতিবেদনের বিষয়টি।
উল্লেখ্য, এজাহারে দাবি করা হয়, বিশা বালী হত্যার ঘটনা ছিল উমেদপুরে। কিন্তু উমেদপুরের কোনো ব্যক্তিকে উক্ত ঘটনার সমর্থনে সাক্ষী হিসেবে প্রসিকিউশন পক্ষ থেকে উপস্থাপন করা হয়নি।
কেন অপহরণ করা হয়েছিল সুখরঞ্জন বালীকে
বিশা বালী হত্যার সমর্থনে প্রসিকিউশনের তালিকায় অন্যতম সাক্ষী ছিলেন সুখরঞ্জন বালী। তিনি বিশা বালীর আপন ভাই। প্রসিকিউশন সাক্ষীর তালিকায় তার নামও অন্তর্ভুক্ত করেছিল। কিন্তু মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজি না হওয়ায় প্রসিকিউশন তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করতে ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনালকে জানানো হয়েছিল এ সাক্ষী পালিয়ে গেছেন। তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এরপরই সুখরঞ্জন বালী ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়েছিলেন সত্য ঘটনা বলার জন্য।
ট্রাইব্যুনালকে জানাতে চেয়েছিলেন সে সময়ে তার চোখে দেখা সত্য ঘটনা। আল্লামা সাঈদীর আইনজীবীরা তাকে উপস্থাপন করতে চেয়েছিলেন ট্রাইব্যুনালে। তখন ট্রাইব্যুনাল বলেছিলেন আগে দরখাস্ত দিয়ে আগামীকাল নিয়ে আসেন। পরের দিন ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার পথে নিজমুল হক নাসিম, এটিএম ফজলে কবীর ও জাহাঙ্গীর হোসেনের ষড়যন্ত্রে তাকে অপহরণ করা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালের গেট থেকে তাকে অপহরণ করে ডিবি। পরে সুখরঞ্জন বালীকে ডিবি ভারতে পাচার করে। দীর্ঘদিন পর ভারত থেকে ফিরে আসেন তিনি। অপহরণের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন এ প্রতিবেদকের কাছেই।
সেফ হাউস কেলেঙ্কারি
ট্রাইব্যুনালের সাক্ষীদের প্রশিক্ষণের জন্য ঢাকার গোলাপবাগে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল সেফ হাউস নামে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। বিভিন্ন মামলায় সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য টার্গেট ব্যক্তিদের এনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। আল্লামা সাঈদীর মামলায় অন্তত ১৩ জন সাক্ষী সেফ হাউসে এসে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করেন। এমনকি এর মধ্যে বেশ কয়েকজনকে ট্রাইব্যুনাল পর্যন্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রসিকিউশন নিশ্চিত হতে না পেরে আর এজলাসের সামনে নেওয়া হয়নি তাদের।
এসব সাক্ষীর বিষয়ে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে একটি আবেদন দিয়ে বলা হয়, তারা পালিয়ে গেছেন। বর্তমানে নিখোঁজ। তাদের নামে তদন্ত কর্মকর্তার তৈরি করা বয়ান সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণের জন্য আবেদন করেন প্রসিকিউশন। নিজামুল হক নাসিমের নেতৃত্বে গঠিত ট্রাইব্যুনাল সেটা অকপটে গ্রহণ করেন ও আমলে নেন।
আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে তখন উঠে আসে এই সাক্ষীরা ‘সেফ হাউসে’ দিনের পর দিন ছিলেন। তথ্য-উপাত্ত দিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর আল্লামা সাঈদীর পক্ষ থেকে এসব সাক্ষীর বিষয়ে একটি আবেদন করা হয়। নিজামুল হক নাসিমের নেতৃত্বে ট্রাইব্যুনাল তখন আবেদনটি খারিজ করে দেয়। বলা হয়, বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ ও বাধাগ্রস্ত করতেই এমন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আমার দেশ। স্কাইপ কেলেঙ্কারিতে উঠে এসেছে পরে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমদ তাকে ডেকে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর রেখে মন্ত্রণালয় থেকে বিদায় দেন।
কারাগারে নিপীড়ন ও হত্যার অভিযোগ
বয়োবৃদ্ধ আল্লামা সাঈদীকে কারাগারে নানা ধরনের নিপীড়নের মধ্যে রাখা হয়েছিল। অসুস্থ অবস্থায় বিভিন্ন মামলার অজুহাতে গাজীপুর থেকে ঢাকায় যাতায়াত করানো হতো প্রিজনভ্যানে। যেখানে বসার ব্যবস্থা নেই। হঠাৎ করে বুকে ব্যথার চিকিৎসার জন্য কারাগার থেকে বর্তমান বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (সাবেক পিজি হাসপাতাল) পাঠানো হয়। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ তাকে সরাসরি পিজিতে না এনে প্রথমে নিয়ে যায় কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারে। সেখান থেকে পাঠানো হয় পিজিতে। মাত্র দুদিন চিকিৎসার পর আল্লামা সাঈদীর মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।
আল্লামা সাঈদীর ছেলে মাসুদ সাঈদী বলেন, ‘দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করি বাবাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। কারাগারে আটক রেখে পরিকল্পিতভাবে তাকে শারীরিকভাবে দুর্বল করা হয়েছিল দিনে দিনে।’