দিল্লিতে শেখ হাসিনার জন্য একটি রাজনৈতিক কার্যালয় গড়ে তোলা হয়েছে। দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা এবং ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার উদ্দেশ্যে ভারতের ডিপ স্টেট তথা গোয়েন্দা সংস্থার পরিকল্পনা ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এই অফিস স্থাপিত হয়েছে বলে ঢাকা, দিল্লি ও কলকাতার কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের জন্য এক অশনিসংকেত এবং কার্যত যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। তাদের মতে, শেখ হাসিনার জন্য রাজনৈতিক কার্যালয় স্থাপন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এক গুরুতর হস্তক্ষেপ। এ ধরনের আধিপত্যবাদী আগ্রাসন মোকাবিলায় জনগণ ও সব রাজনৈতিক শক্তির জাতীয় ঐক্য ছাড়া বিকল্প নেই।
গত বছরের জুলাই বিপ্লবে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দিল্লিতে আশ্রয় নেওয়ার এক বছর পরই ভারতের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনার জন্য এ অফিস তৈরি করা হলো। ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা একে তার সচিবালয় হিসেবে উল্লেখ করছেন। কঠোর নিরাপত্তায় ঘেরা দিল্লির একটি সুরক্ষিত ভবনেই শেখ হাসিনার অবস্থানের পাশাপাশি এই সচিবালয় গড়ে তোলা হয়েছে, যেখানে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা রাখা হয়েছে। শেখ হাসিনার পক্ষে যোগাযোগ রক্ষা ও বার্তা আদান-প্রদানের জন্য দিল্লির এক প্রভাবশালী বাঙালি সাংবাদিককে নিয়োগ করা হয়েছে।
সূত্রগুলো জানিয়েছে, এই সাংবাদিক ইতোমধ্যে সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করেছেন, যার মূল উদ্দেশ্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপে রাখা এবং শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশে পুনর্বাসনের পরিকল্পনা এগিয়ে নেওয়া। আন্তর্জাতিক মহলে জনমত তৈরির জন্য লন্ডনে একটি লবিং ফার্ম নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের বিষয়টি জাতিসংঘে তোলার জন্য ব্রিটিশ আইনজীবী স্টিভেন পলস কেসি ও অ্যালেক্স টিনসলেকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা জাতিসংঘে আবেদন করেছেন যাতে বাংলাদেশ সরকারকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে চাপ দেওয়া হয়।
দিল্লিভিত্তিক সচিবালয়ে শেখ হাসিনা নিয়মিত সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন বলেও সূত্র জানিয়েছে। চলতি মাসের শুরুর দিকে তিনি সরাসরি বৈঠক করেছেন ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, জাহাঙ্গীর কবীর নানক, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও সুজিত রায় নন্দীর সঙ্গে। সব কার্যক্রমই ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার নকশা অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে, আর তত্ত্বাবধান করছেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল। শেখ হাসিনা দিল্লিতে পালিয়ে গেলে তিনিই তাকে রিসিভ করেছিলেন এবং বর্তমানে তার অভিভাবকের ভূমিকা পালন করছেন, যেভাবে অতীতে প্রণব মুখার্জী করেছিলেন।
গত জুলাই বিপ্লবের পর থেকেই বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে দিল্লি নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে আসছে—কখনো সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ, কখনো সীমান্তে উত্তেজনা, আবার কখনো উসকানিমূলক অডিও ফাঁসের মাধ্যমে। তাদের ধারণা ছিল, অব্যাহত চাপের মুখে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভারতের সঙ্গে সমঝোতায় বাধ্য হবেন এবং আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করা সম্ভব হবে। কিন্তু বাস্তবে এর কিছুই হয়নি। ড. ইউনূস স্বাধীন ও ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি নিয়েছেন, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হয়েছে এবং শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
ফলে ভারতের নীতিনির্ধারকরা এখন দ্বিধায় পড়েছে। বিএনপি ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা থাকলেও তাদের পুরোপুরি ভরসা করছে না দিল্লি। এই পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনাকে দীর্ঘমেয়াদে দিল্লিতেই রাখার কৌশল নিয়েছে ভারত। দালাইলামা মডেল অনুসরণ করে তার কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে দেওয়া হচ্ছে। একইসঙ্গে আওয়ামী লীগপন্থি বয়ান ছড়িয়ে দলীয় মনোবল ধরে রাখতে কাজ করছে ভারতীয় ডিপ স্টেট।
দিল্লি প্রেস ক্লাবের সভাপতি গৌতম লাহিড়ীর বক্তব্য এই প্রেক্ষাপটে আলোচনায় এসেছে। তিনি বলেছেন, শেখ হাসিনা দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর মতোই প্রটোকল পাচ্ছেন এবং নিয়মিত তার সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। তিনি তুলনা টেনেছেন দালাইলামার সঙ্গে এবং দাবি করেছেন, শেখ হাসিনা এ বছরই বাংলাদেশে ফিরে আসতে পারেন।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, এসব পদক্ষেপ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নতুন করে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. দিলারা চৌধুরী এটিকে যুদ্ধ ঘোষণার সমতুল্য আখ্যা দিয়ে বলেছেন, ভারতের আগ্রাসন মোকাবিলায় জাতীয় ঐক্য অপরিহার্য। অন্যদিকে ড. মাহবুব উল্লাহ একে ভারতের আধিপত্যবাদী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ বলে মন্তব্য করেছেন এবং সতর্ক করেছেন যে শেখ হাসিনাকে তারা দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিকভাবে টিকিয়ে রাখবে।
সব মিলিয়ে দিল্লিতে শেখ হাসিনার জন্য রাজনৈতিক কার্যালয় স্থাপন শুধু ভারতের রাজনৈতিক পদক্ষেপ নয়, বরং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে গভীর হস্তক্ষেপের নতুন অধ্যায়।