জুলাই ঘোষণাপত্র বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। তবে এর মধ্যে থাকা গঠনগত ও বাস্তব দুর্বলতাগুলো ঘোষণার কার্যকারিতা ও গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। জাতীয় ঐক্যের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর বোঝাপড়া ও সমঝোতার প্রচেষ্টা প্রশংসনীয় হলেও, ঘোষণাপত্রটি বাস্তবতার আলোকে সম্যক মূল্যায়ন করা জরুরি।
ঘোষণাপত্রে বহুদলীয় কাঠামো ও জাতীয় ঐক্যের কথা বলা হলেও কার্যকর রূপরেখার স্পষ্ট অভাব রয়েছে। এটি মূলত কিছু মানুষের আবেগপ্রবণ আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন, যেখানে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামোর বাস্তব রূপায়ণ উপেক্ষিত হয়েছে। ঘোষণায় যে নীতিগুলো উল্লেখ করা হয়েছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই জনগণের চিন্তাধারার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বাস্তবায়নের কৌশল, সময়সীমা ও নির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা না থাকায় এটি আবেগনির্ভর দলিল হিসেবে সীমাবদ্ধ থেকেছে।
এছাড়া দলীয় স্বার্থ ও ক্ষমতার সমীকরণে অনেক সময় জাতীয় স্বার্থকে গৌণ করে তোলা হতে পারে, যা জনগণের আস্থা ক্ষুণ্ণ করার ঝুঁকি তৈরি করে। জাতীয় ঐক্য ও সহাবস্থানের যে অঙ্গীকার ঘোষণায় এসেছে, তা রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রতিফলিত হয়নি; বরং দ্বন্দ্ব ও অসহযোগিতা বৃদ্ধির আশঙ্কা থেকেই গেছে।
আন্তর্জাতিকভাবে ঘোষণাপত্র কূটনৈতিক আগ্রহ জাগালেও গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় এতে উপেক্ষিত রয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তন, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, উন্নত দেশগুলোর দায়বদ্ধতা, ফিলিস্তিন সংকট ও রোহিঙ্গা সমস্যা ঘোষণায় যথাযথ গুরুত্ব পায়নি। বৈশ্বিক প্রযুক্তি ভারসাম্য ও তথ্যনিরাপত্তার মতো ভবিষ্যতমুখী ইস্যুগুলোও অনুপস্থিত, যা একটি বড় ঘাটতি।
অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাস্তবতায়ও ঘোষণাপত্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। জাতির বিপ্লবী সংগ্রাম, শাপলা চত্বরের মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে উপেক্ষা করা ইতিহাসের প্রতি অবিচার এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করেছে। গণতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতির প্রমাণ তখনই পাওয়া যাবে, যখন সব পক্ষের ভুল ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের স্বীকৃতি দেওয়া হবে।
এছাড়া বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো দীর্ঘদিনের মানবাধিকার সংকট ঘোষণাপত্রে জোরালোভাবে প্রতিফলিত হয়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নামে ‘ক্রসফায়ার’ বা বেআইনি হত্যার বিষয়টি উপেক্ষা করা শুধু হতাশাজনকই নয়, বরং মানবাধিকারের অগ্রযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। একটি দায়িত্বশীল রাষ্ট্রে নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা অগ্রগণ্য হওয়া উচিত।
সবশেষে বলা যায়, যদি ঘোষণাপত্রটি আরও জনবান্ধব, বাস্তবধর্মী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হতো, তবে এটি একটি ন্যায্য, জবাবদিহিমূলক ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পথে ঐতিহাসিক মাইলফলক হয়ে উঠতে পারত। কিছু সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হলেও ঘোষণার পূর্ণতা অর্জনে এখনো বহু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক