ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে নারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনীহা রয়েছে বলে মনে করছেন সচেতন শিক্ষার্থীরা। নির্বাচন সামনে রেখে প্রকাশিত প্রার্থী ও ভোটার তালিকা পর্যবেক্ষণ করলেও সেটা স্পষ্ট। ঢাবিতে ছাত্রীর সংখ্যা ১৮ হাজার ৯৫৯ জন, যা মোট ভোটারের প্রায় অর্ধেক। কিন্তু প্রার্থিতায় নারী শিক্ষার্থীর উপস্থিতি সে তুলনায় একেবারে নগণ্য। ডাকসুর প্রার্থী তালিকা যাচাই ও বৈধকরণ শেষে মোট বৈধ প্রার্থীর সংখ্যা ৪৬২ জন। এর মধ্যে ছাত্রী মাত্র ৬০ জন। এটি মোট প্রার্থীর প্রায় ১৩ শতাংশ।
এছাড়া মেয়েদের পাঁচ হলে ৬৫ পদে মোট প্রার্থী মাত্র ১৮৮ জন। রাজনীতির আঁতুড়ঘরখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে পরতে পরতে রাজনীতির ছোঁয়া, সেখানে নারীদের এমন পিছিয়ে পড়া নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। রাজনীতিতে মেয়েদের অংশগ্রহণ এত সীমিত হওয়ার কারণ হিসেবে সচেতন শিক্ষার্থীরা মনে করেনÑপ্রথাগত পুরুষতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সাইবার বুলিং, নিরাপত্তাহীনতা, সামাজিক কুসংস্কার, দলীয় বাছাই নীতি এবং প্রতিষ্ঠানগত অবমূল্যায়ন। এসব প্রতিবন্ধকতা নারী শিক্ষার্থীদের রাজনীতিতে নামা-চলা বাধাগ্রস্ত করছে।
এদিকে ডাকসুর কেন্দ্রীয় সংসদের ২৮টি মূল পদের মধ্যে নারী প্রার্থীর সংখ্যা নগণ্য। তবে অনেক উচ্চপদের পাশাপাশি এমন পদও আছে, যেখানে একজন নারী প্রার্থীও দেখা যায়নি। বিশেষত সমাজসেবা সম্পাদক, ছাত্র পরিবহন সম্পাদক ও আন্তর্জাতিক সম্পাদকÑ এ তিন পদে কোনো নারী প্রার্থী নেই। পাশাপাশি সাধারণ সম্পাদকসহ (জিএস) চারটি পদে মাত্র একজন করে নারী প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছেন।
তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ডাকসুর ভিপি পদে ৪৮ প্রার্থীর মধ্যে পাঁচজন নারী। জিএস পদে মাত্র একজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এজিএস পদে ২৮ প্রার্থীর মধ্যে নারী মাত্র চারজন। এছাড়া মানবাধিকার ও আইন সম্পাদক পদে ১১ জনের মধ্যে তিনজন নারী। গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে ১১ জনের মধ্যে চারজন, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে ১৯ জনের মধ্যে দুজন এবং সদস্য পদে ২১৫ জনের মধ্যে মাত্র ২৪ জন নারী প্রার্থী লড়ছেন।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, কমনরুম, রিডিংরুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদকের মতো পদগুলোয় তুলনামূলকভাবে নারী প্রার্থীর অংশগ্রহণ বেশি। কমনরুম, রিডিংরুম, ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক পদে ১১ প্রার্থীর মধ্যে ৯ জনই নারী। এ পরিসংখ্যান ইঙ্গিত করে, নারী প্রার্থীরা মূলত সেবামুখী কিছু অনানুষ্ঠানিক পদের জন্য লড়তে চাচ্ছেন কিন্তু নেতৃস্থানীয় পদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তারা নেই।
এছাড়া নির্বাচনীয় প্যানেলগুলোতেও একই দশা। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল প্যানেলে নারী প্রার্থী মাত্র দুজন। তাদের মধ্যে চেমন ফারিয়া ইসলাম মেঘলা কমনরুম, রিডিংরুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক পদে এবং মেহেরুন্নেসা কেয়া সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্যানেল ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটে নারী প্রার্থী চারজন। তাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক পদে ফাতিমা তাসনীম জুমা, কমনরুম, রিডিংরুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক পদে উম্মে ছালমা এবং বাকি দুজনের মধ্যে আফসানা আক্তার ও সাবিকুন্নাহার তামান্না কার্যনির্বাহী সদস্য পদে লড়বেন।
তবে ডান-বাম ও স্বতন্ত্র জোটগুলোর মধ্যে বামপন্থি ও প্রগতিশীল প্যানেলগুলোয় তুলনামূলকভাবে নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বেশি।
নারী প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজনৈতিক অঙ্গনে এখনো নারীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ গড়ে ওঠেনি। ভয়ের একটি পরিবেশ এখনো বিরাজ করছে। এছাড়া অনলাইন ও অফলাইনে হেনস্তা, সাইবার বুলিং ও মানহানির ভয়ে অনেকেই রাজনীতিতে এগোতে ইচ্ছুক নন। ছাত্রীদের দাবি, প্যানেল গঠনে ‘পদবিন্যাস’ ও ‘মনোনয়ন নীতি’ প্রক্রিয়ায় নারীদের যথাযথ স্থান দেওয়া হয়নি। নারী প্রার্থীদের মূল্যায়ন করা হয়নি। ছাত্রীদের কিছু সম্পাদকীয় পদে রাখা হলেও মূল পদগুলোয় রাখা হয়নি। অধিকাংশকেই সদস্য পদে রাখা হয়েছে, যা পদ বণ্টনে স্পষ্ট বৈষম্য।
ছাত্র অধিকার পরিষদের প্যানেল থেকে ডাকসুর একমাত্র নারী জিএস প্রার্থী সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এখনো একটি ভীতির পরিবেশ বিরাজ করছে। কোনো নারী রাজনীতিতে এলেও টিকে থাকাটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে যায়। কখনো তাকে ভীতি প্রদর্শন করা হয়, কখনো সাইবার বুলিং করা হয় আবার কখনো চরিত্র হননের চেষ্টা করার মতো ঘটনা ঘটে।
বামপন্থি সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনের সাবেক নেত্রী ও ডাকসুর স্বতন্ত্র ভিপি প্রার্থী উমামা ফাতেমা বলেন, ‘নারীদের হেনস্তার বিষয়ে প্রশাসনের কাছে গেলে তারা স্থায়ী কোনো সমাধান দিতে পারছে না। নারীদের নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা থাকে না। তবে এখন ডাকসুর ডামাডোলে সবাই নারীবান্ধব সাজার চেষ্টা করছে।’
তিনি বলেন, নিরাপত্তাব্যবস্থার অভাব মেয়েদের রাজনীতিতে নামতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী শেখ সায়িদা আফরিন শাফি বলেন, ‘রাজনীতিতে নারীদের অনাগ্রহের প্রধান কারণÑরাজনীতি নিরাপদ নয়। পরিবারের সমর্থনের অভাবও বড় কারণ। যারা রাজনীতি করে, সমাজ তাদের ভালো চোখে দেখে না। এই সামাজিক স্টিগমা ও পরিবারের অসুবিধাও মেয়েদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণে যথেষ্ট বাধা দিয়ে থাকে বলে প্রতীয়মান হয়।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যাওয়ার নজির
এদিকে আসন্ন ডাকসু নির্বাচনের হল সংসদে দুই প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। উভয়েই বহিরাঙ্গন ক্রীড়া সম্পাদক পদে প্রার্থী হয়েছেন। এর মধ্যে একজন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের এবং অন্যজন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ সমর্থক বলে জানা গেছে।
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল থেকে বহিরাঙ্গন ক্রীড়া সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন রেহেনা আক্তার। একই পদে প্রার্থী হয়েছেন শামসুন নাহার হলের লামিয়া আক্তার লিমা। তাদের বিপক্ষে আর কোনো প্রার্থী না থাকায় তারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হচ্ছেন।
হল সংসদ নির্বাচনে ছাত্রদল ছাড়া অন্য কোনো ছাত্র সংগঠন প্যানেল দেয়নি। এ বিষয়ে ছাত্রদলের প্যানেল থেকে সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা শেখ তানভীর বারী হামিম বলেন, ‘লামিয়া আক্তার লিমা আমাদের প্যানেল থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হচ্ছেন আর বঙ্গমাতা হলে নির্বাচিত হতে যাওয়া রেহেনা আক্তার বাগছাস সমর্থক বলে আমরা জেনেছি।’
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা
উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়েদ ইমতিয়াজ বলেন, নারী শিক্ষার্থীরা রাজনীতিতে অনাগ্রহী হওয়ার পেছনে এ দেশের পুরুষতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিই দায়ী। তিনি বলেন, এ দেশের রাজনৈতিক চর্চা জ্ঞানভিত্তিক নয়; বরং পেশিশক্তি দিয়ে চলে। প্রথাগতভাবে এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি পুরুষতান্ত্রিক হওয়ার কারণে নারীদের কোণঠাসা করে রাখা হয়।
পুরুষতান্ত্রিক জাতীয় রাজনীতির ধারাবাহিকতায় ডাকসু নির্বাচনে এমন প্রভাব পড়ছে উল্লেখ করে এই অধ্যাপক বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে দেশের ক্যাম্পাসগুলোয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না। ফলে নারী শিক্ষার্থীদের মাঝে রাজনীতি সচেতনতা গড়ে উঠছে না। ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়মিত হলে নারী শিক্ষার্থীরা আগামীতে আগ্রহী হয়ে উঠবে, বিদ্যমান ভয়ের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে পারবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল মানসুর আহমদ বলেন, দেশে বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো ও ছাত্র রাজনীতির অস্থির আচরণ নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিনিয়ত সাইবার বুলিং তাদের অনাগ্রহী করে তুলছে।
বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতিতে প্রতিনিধিত্ব না থাকলে তা ভবিষ্যৎ নীতিনির্ধারণী ও সামাজিক পরিবর্তনে নারীদের কোণঠাসা করে রাখে। ডাকসুকে দীর্ঘকাল ধরে ‘নেতা তৈরির কারখানা’ বলা হয়। কিন্তু সেখানে যদি মেয়েদের পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে দেশের রাজনীতি নারী নেতৃত্ব সংকটে পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।