কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের হারুয়া এলাকায় নরসুন্দা নদীর তীরে প্রায় আড়াইশ বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ অবস্থিত। সময়ের সঙ্গে এটি শুধু মুসলমানদের নয়, সকল ধর্মের মানুষের কাছেই এক সর্বজনীন পবিত্র স্থান হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। মসজিদের স্থাপত্যশৈলী মনোমুগ্ধকর হলেও, দেশজুড়ে এর বিশেষ পরিচিতি এসেছে দানবাক্স ঘিরে।
দানবাক্সের বিস্ময়
‘পাগলা মসজিদ’ নাম উচ্চারণ করলেই মানুষের মনে প্রথম আসে কোটি কোটি টাকা, বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণালঙ্কারে ভরা দানবাক্সের কথা। প্রতি তিন মাস অন্তর দানবাক্স খোলার পর সেখানে পাওয়া যায় বিপুল অর্থ। সর্বশেষ চলতি বছরের ৩০ আগস্ট দানসিন্দুক থেকে রেকর্ড ১২ কোটি ৯ লাখ ৩৭ হাজার ২২০ টাকা সংগ্রহ হয়, যা ১৩টি দানসিন্দুকে জমা পড়েছিল চার মাস সতেরো দিনে।
দান সংগ্রহের প্রক্রিয়াও বিশেষভাবে পরিচালিত হয়। পুলিশি নিরাপত্তায় বস্তায় ভরা টাকা মসজিদের দোতলায় নিয়ে গণনা করেন ব্যাংক কর্মকর্তা, শিক্ষক ও ছাত্ররা। পরে সেই অর্থ জমা রাখা হয় মসজিদের ব্যাংক হিসাব নম্বরে।
ইতিহাস ও জনশ্রুতি
মসজিদের প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে আধ্যাত্মিক কাহিনি। প্রায় আড়াইশ বছর আগে এক আধ্যাত্মিক সাধক নরসুন্দা নদীর পানিতে মাদুর পেতে ভেসে এসে এখানেই স্থির হন। তার মৃত্যু পরবর্তী সময়ে তার কবরের পাশে গড়ে ওঠে এ মসজিদ, যা ধীরে ধীরে ‘পাগলা মসজিদ’ নামে পরিচিত হয়। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দেওয়ান হয়বত খানের বংশধর জুলকরণ খানের স্ত্রী।
দানের বহুমুখী ব্যবহার
মানুষের বিশ্বাস, খাঁটি নিয়তে এখানে দান করলে মানত পূর্ণ হয়। এজন্য নগদ অর্থ ছাড়াও স্বর্ণালঙ্কার, বৈদেশিক মুদ্রা, গবাদিপশু, হাঁস–মুরগিসহ নানা জিনিস দান করেন ভক্তরা। দানের অর্থে পরিচালিত হয় মসজিদের পাশের হাফেজিয়া মাদ্রাসা, যেখানে এতিম শিশুরা পড়াশোনা করে এবং তাদের যাবতীয় ভরণপোষণ চালানো হয়। পাশাপাশি অসহায় ও দূরারোগ্য রোগীদের চিকিৎসায়ও ব্যবহার করা হয় এই অর্থের লভ্যাংশ।
ইসলামিক কমপ্লেক্সের পরিকল্পনা
মসজিদের বিশাল দানকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানের পাগলা মসজিদ ইসলামিক কমপ্লেক্স। তুরস্কের স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই কমপ্লেক্সে একসঙ্গে ৩৫ হাজার মুসুল্লি নামাজ আদায় করতে পারবেন, থাকবে ৫ হাজার নারীর আলাদা নামাজের স্থান এবং ২০০ গাড়ির পার্কিং সুবিধা।
চ্যালেঞ্জ ও বিতর্ক
প্রতিদিন মানতের দানসামগ্রী নিলামে তোলা হলেও স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা একটি সিন্ডিকেটের কারণে প্রকৃত মূল্য পাওয়া যায় না—এমন অভিযোগ রয়েছে। মুসল্লিদের দাবি, নিলাম প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে আলাদা সাব-কমিটি গঠন জরুরি।
আধুনিক দানপ্রক্রিয়া
এখন অনলাইনেও দান করা সম্ভব। www.paglamosque.org ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে মানুষ সরাসরি দান পাঠাতে পারছে। ওয়েবসাইটে পাওয়া যাচ্ছে মসজিদের ইতিহাস, নামাজের সময়সূচি ও অন্যান্য তথ্যও।
পাগলা মসজিদ আজ শুধু একটি ধর্মীয় স্থান নয়, বরং বিশ্বাস, আস্থা ও উদারতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। কোটি কোটি টাকার দানের এই ধারাবাহিকতা দেশজুড়ে কৌতূহল ও বিস্ময়ের জন্ম দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।