মব সন্ত্রাসে বাবা রূপলাল রবিদাসকে হারানোর পর স্কুল ছেড়ে বাবার পেশায় বসতে হয়েছিল জয় রবিদাসকে। রংপুরের তারাগঞ্জ বাজারের ছোট্ট কাঠের চৌকিতে বসে জুতা সেলাই করে সংসারের আয় যোগাতে বাধ্য হয়েছিল মাত্র ১৪ বছরের এই কিশোর। তবে মানুষের সহমর্মিতা ও সহযোগিতার হাত তাকে আবার ফিরিয়ে এনেছে স্কুলে। হাতে উঠেছে বইখাতা। এখন তার স্বপ্ন, বড় হয়ে একজন আইনজীবী হওয়ার।
জয় তারাগঞ্জ সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। বাবাকে হারানোর পর তার পড়াশোনা হয়ে পড়ে অনিশ্চিত, স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। সংসারের খরচ চালাতে বাবার জায়গায় বসতে হয়, যেখানে নিয়মিত বসতেন রূপলাল রবিদাস।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে জয়ের ফুটপাতে বসে জুতা সেলাইয়ের ছবি প্রকাশ হলে অসংখ্য মানুষ ও প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসে, সাহায্যের হাত বাড়ায়। জয় জানায়, ‘অনেকেই আমাদের সাহায্য করেছেন, পাশে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু বাবাকে হারানোর কষ্ট আমি ভুলতে পারছি না। সংসারে বাবার অনুপস্থিতি আমাদের জন্য ভীষণ কষ্টের।’
কিছুটা থেমে জয় বলে, ‘আমি এখন আবার নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছি। সহপাঠী আর শিক্ষকরা আমাকে সাহায্য করছে, উৎসাহ দিচ্ছে। পড়াশোনা শেষ করে আমি আইনজীবী হতে চাই।’
বাবাকে ছাড়া দুই বোন, মা আর ঠাকুমাকে নিয়েই জয়ের পরিবার। বড় বোন নুপুর ডিগ্রির প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী, ছোট বোন পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। নুপুর বলেন, ‘জয় যেদিন বাবার পেশায় যোগ দিল, খুব কেঁদেছিলাম। করার মতো কিছু ছিল না। পরে যখন অনেকে সাহায্য করলেন, তখন আবার আশা পেলাম। বাবা ছিলেন আমাদের খুঁটি, শক্তি ও অনুপ্রেরণা। তিনি আর নেই, তবে তার স্বপ্ন আমাদের ভেতরে বেঁচে আছে।’
জয়ের মা মালতি রানী রবিদাস বলেন, ‘স্বামী ছিলেন সংসারের একমাত্র ভরসা। ফুটপাতে জুতা সেলাই করতেন, কিন্তু সন্তানের পড়াশোনার স্বপ্ন দেখতেন খুব। ছেলেটা আবার স্কুলে ফিরেছে, এটাই স্বস্তি। তবে তার চোখের ভয় আমি লুকাতে পারি না।’
তারাগঞ্জ সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু মুসা বলেন, ‘জয় মেধাবী ছাত্র। আমরা তাকে মানসিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি। চাই সে পড়াশোনা শেষ করে মানুষের মতো মানুষ হোক।’
সহপাঠীরা জানায়, জয় এখনো বাবার শূন্যতা থেকে বের হতে পারেনি। তবু লড়াই করছে। তারা সবসময় জয়ের পাশে আছে।
বুড়িরহাট এলাকার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মোক্তার হোসেন বলেন, ‘এই ঘটনা শুধু একটি পরিবারকে নয়, পুরো সমাজকে নাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা সবাই লজ্জিত। এখন আমাদের দায়িত্ব—এই পরিবারকে আগলে রাখা।’
তারাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুবেল রানা বলেন, ‘সরকারি ও বেসরকারি সহায়তা পরিবারটি পেয়েছে। রূপলালের বড় মেয়ের জন্য একটি চাকরি ও বাজারে দোকানঘর দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। সন্তানদের পড়াশোনাও নিশ্চিত করা হয়েছে।’
গত ৯ আগস্ট রাতে ভ্যানে বাড়ি ফেরার পথে বুড়িরহাট বটতলায় গণপিটুনিতে নিহত হন রূপলাল রবিদাস ও তার ভাগ্নিজামাই প্রদীপ লাল রবিদাস। ভ্যানচোর সন্দেহে তাদের পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরদিন রূপলালের স্ত্রী অজ্ঞাত ৭০০ জনকে আসামি করে মামলা করেন। ভিডিও ফুটেজ দেখে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ, বাকিরা এখনো পলাতক।