রাজনীতির মাঠে কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ার পর নির্বাচনি রাজনীতি থেকেও ছিটকে পড়তে যাচ্ছে গণঅভ্যুত্থানে পতিত দল আওয়ামী লীগ। অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর দলটির নিবন্ধনের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধের গেজেট প্রকাশসাপেক্ষে নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর সম্ভাবনার কথা জানা গেছে। এক্ষেত্রে বিচারিক কার্যক্রম শেষ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত রাখা হতে পারে।
ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সভাপতি ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরই মূলত দলটির আর রাজনৈতিক কোনো কার্যক্রম নেই। প্রথম কয়েক সারির নেতাদের অধিকাংশই দেশের বাইরে পলাতক। দেশের ভেতরেও অনেকে গা-ঢাকা দিয়ে রয়েছেন। এ অবস্থায় দলটির সব কার্যালয় নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। আইনে কোনো নিবন্ধিত দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় সক্রিয় না থাকলেও নিবন্ধন বাতিল করার কথা বলা আছে। তা ছাড়া সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ দলের নিবন্ধন বাতিলের সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে আইনে।
এদিকে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের সরকারি সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক অঙ্গনে স্বস্তির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। উচ্ছ্বাস ও উল্লাস প্রকাশ করেছেন দেড় দশকে নিপীড়নের শিকার রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। দেরিতে হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন, ব্যক্তি ও মহল। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির পক্ষ থেকে দলটির মহাসচিব বিবৃতি দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করেছেন।
সরকারের সিদ্ধান্তের খবর ছড়িয়ে পড়ায় শনিবার রাত থেকেই সারা দেশে আনন্দ মিছিল, মিষ্টি বিতরণ, শোকরানা মোনাজাতসহ নানাভাবে বিজয় উল্লাস করেছে ছাত্রসমাজসহ জুলাই অভ্যুত্থানের পক্ষের সব রাজনৈতিক শক্তি। তারা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পাশাপাশি আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দলটিকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধের দাবি তুলেছে। আজ দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধের চূড়ান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হলে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা রাজধানীতে আনন্দ মিছিল করার কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আওয়ামী লীগ গত সাড়ে ১৫ বছর হত্যা, গুম, নির্যাতন ও দমন-পীড়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ কায়েম করে। এজন্য দলটিকে আজ অনিবার্য পরিণামের মুখোমুখি হতে হয়েছে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধে নির্বাহী আদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ করে শাস্তির মুখোমুখি করার আহবান জানিয়েছেন তারা। সেই সঙ্গে দলটির শীর্ষ নেতাসহ ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সম্পৃক্তদের বিচার শেষ করে তা বাস্তবায়ন করার কথাও বলেছেন।
গত শনিবার রাতে উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ সভায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে গণহত্যার দায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচারের বিধান যুক্ত করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্যাইব্যুনালের সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়। পরে ওই রাতেই রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন তা অধ্যাদেশ আকারে জারি করেন।
আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের বিষয়ে সব আনুষ্ঠানিকতা গুছিয়ে এনেছে অন্তর্বর্তী সরকার। গতকাল রোববার সন্ত্রাসবিরোধী আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনী অনুমোদন দেয় উপদেষ্টা পরিষদ। গতকালই সেটা অধ্যাদেশ আকারে জারি হয়। এক্ষেত্রে আজই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করে দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে।
শনিবার রাতে সরকারের তরফ থেকে বলা হয়, পরবর্তী কার্যদিবসে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের আদেশ জারি করা হবে। এ হিসাবে আজ সোমবারই সেটা সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে।
গত ৬ মে গভীর রাতে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ‘গোপনে’ দেশত্যাগের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবিটি জোরালো হয়। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে গত বৃহস্পতিবার রাতে ছাত্ররা রাস্তায় নেমে আসেন। তারা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। ছাত্রদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে জামায়াত ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, গণ অধিকার পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও তাদের ছাত্রসংগঠনের নেতৃবৃন্দ রাজপথে নেমে পড়েন। শুক্রবার তারা শাহবাগে ব্লকেড কর্মসূচি পালন করেন। পরে শুক্রবার রাতেই তারা এক ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন। ছাত্রদের এ আন্দোলনের মুখে প্রধান উপদেষ্টা উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি বৈঠক ডাকেন। ওই বৈঠক থেকেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে টেলিফোনে আলোচনা করে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত আসে।
সরকারের ওই সিদ্ধান্ত জানার সঙ্গে সঙ্গেই আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে ফিরে আসে স্বস্তি। ওই রাতেই শাহবাগসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ শুরু হয়। ধর্মীয় দলগুলো শোকরানা মোনাজাত করে। রাজনৈতিক দলগুলোও সরকারের এ সিদ্ধান্তে দলীয় অবস্থান তুলে ধরে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ওই রাতেই দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আদালতের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক বলে উল্লেখ করা হয়। আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), জামায়াতসহ অন্যান্য দলও সরকারকে সাধুবাদ জানিয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে।
গতকাল এক বিবৃতিতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘বিলম্বে হলেও অন্তর্বর্তী সরকার ফ্যাসিবাদী সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার দ্রুত করার এবং বিচারকার্য নির্বিঘ্ন করার স্বার্থে ফ্যাসিবাদী দল আওয়ামী লীগ ও তার সঙ্গে যুক্ত সব সংগঠনের কার্যক্রম বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রাসঙ্গিক আইন সংশোধন করে বিচারিক প্রক্রিয়ায় গুম, খুন, নিপীড়ন ও জনগণের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন অপশাসন চালনাকারী, ফ্যাসিবাদী দলের বিচার করার সিদ্ধান্তকে আমরা সঠিক বলে মনে করি। এতে আমরা আনন্দিত।
বিএনপি আগেই এ দাবি করেছিল-এমন দাবি করে বিবৃতিতে ফখরুল বলেন, আমাদের দাবি মেনে আগেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে চাপের মুখে ব্যবস্থা নেওয়ার মতো বিব্রতকর ও অনভিপ্রেত অবস্থায় সরকারকে পড়তে হতো না।
আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধে সরকারের সিদ্ধান্তকে বিএনপি স্বাগত জানিয়েছে উল্লেখ করে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ গতকাল এক অনুষ্ঠানে বলেন, আওয়ামী লীগ ইজ নো মোর পলিটিক্যাল পার্টি। একটা মাফিয়া পার্টি, এটা একটা ফ্যাসিবাদী দল। সুতরাং রাজনৈতিক তকমা দিতে চাই না। আওয়ামী লীগের ডিএনএতেই গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রের চর্চা নেই।
যে আইনের অধীনে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেই সন্ত্রাসবিরোধী আইনে সংশোধনী আনার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণায় আমরা স্বাগত জানিয়েছি।