বাংলাদেশের আইনের জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন এবং সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। ৪ মে বাংলাদেশ রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যুতে সুপ্রিম কোর্ট তার এক উজ্জ্বল তারকাকে হারাল।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক অসম্ভব ধরনের একজন ভালো মানুষ ছিলেন। এমন মানুষের উপস্থিতি আমাদের দেশে, সমাজে ও সর্বোচ্চ আদালতে বিরল। তিনি ছিলেন একেবারে ব্যতিক্রমধর্মী ব্যক্তিত্ব—কথায়, কাজে, বলনে, চলনে; এককথায় ‘পারফেক্ট জেন্টলম্যান’। কথা বলতেন পরিশীলিতভাবে ও তার সহজাত স্মার্ট ভঙ্গিমায়। তার কথা বা আলাপের শব্দচয়ন ছিল অসাধারণ। তার ব্যবহার ও আচরণে প্রজ্ঞা, বিনয় ও ব্যক্তিত্বের ছাপ ফুটে উঠত। তিনি কাউকে আঘাত করে কথা বলতেন না। চিল্লিয়ে রগ খাড়া করে কথা বলা ছিল তার স্বভাববিরোধী। তবে সত্য কথা যুক্তি দিয়ে জোরালোভাবে ভদ্রতার উচ্চমার্গে উঠে বলতে পারতেন অনায়াসে।
তার সঙ্গে আমার পরিচয় ৩৬ বছরের, ১৯৮৯ সালে আমার লন্ডনে আসার কিছু দিনের মধ্যে তিনি লন্ডন সফরে এলে তার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয়। তখন তিনি ছিলেন বাংলাদেশে জুনিয়র আইনজীবী, মাত্র তিন-চার বছর আগে ১৯৮৫ সালে দেশে ফিরে গেছেন। লন্ডনে এলে তখন ‘Inns of Court School of Law’-এর Manual সবসময় ডায়েরির মতো তার সঙ্গে থাকত। সুযোগ পেলেই পড়তেন। কখনো অযথা সময় নষ্ট করতেন না; বরং সবসময় সময়ের সর্বোচ্চ ব্যবহারই যেন তার সাধনা এমনটি বোঝা যেত। সময়ানুবর্তিতা ও নিয়মানুবর্তিতার এক মূর্ত প্রতীক ছিলেন ব্যারিস্টার রাজ্জাক। তরুণ আইনজীবীদের আইডল ছিলেন তিনি, সহজেই তাদের সঙ্গে মত বিনিময় করতে পারতেন।
এরপর যতবারই লন্ডন সফর করেছেন, তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে, নিদেনপক্ষে ফোনে কথা হয়েছে। একাধিকবার হিথ্রো এয়ারপোর্টে তাকে রিসিভ করেছি, অথবা সি অফ করেছি। লন্ডনে তাকে নিয়ে বহু সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম আয়োজন করেছি। বাংলাদেশে গেলেও সুপ্রিম কোর্টে অথবা নয়াপল্টনে সিটি হার্টে তার চ্যাম্বারে কথা হয়েছে, লম্বা আলাপ হয়েছে। এক দশকেরও বেশি সময় লন্ডনে তার নির্বাসিত জীবনে আরো ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ হয়েছে। তার স্নেহধন্যদের মধ্যে অন্যতম ছিলাম আমি। তার নির্বাসিত জীবনে বিলেতে পুনর্বার প্র্যাকটিসে আসা, নতুন চ্যাম্বারে যোগ দেওয়া, অসুস্থতার সময় ব্রিটিশ জুরি সার্ভিসে ডাকা ও এক্সাম্টেড পাওয়া, পাওয়ার অব অ্যাটর্নি-সংক্রান্ত জটিলতাসহ নিজস্ব বহু ব্যাপারে আমার সঙ্গে পরামর্শ করতেন, আমার মতামত চাইতেন। আমি যখনই তার সান্নিধ্যে যেতাম কিছু না কিছু শেখার চেষ্টা করতাম। তিনি ছিলেন জ্ঞানের ভান্ডার। তাকে নিয়ে যে কত স্মৃতি! ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে তার চমৎকার সেন্স অব হিউমার শুনেছি অনেকবার।
তার সঙ্গে দীর্ঘ সময়ের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতায় কখনো তাকে অযথা কথা বলতে দেখিনি, দেখিনি কারো গিবত করতে। তার দৃশ্যত পরম শত্রুর ব্যাপারেও কথা বলতেন যথাযথ সম্মান দিয়ে। যেকোনো বিষয়ে যা আছে তা-ই বলতেন, বাড়িয়ে বলতেন না, কমিয়েও বলতেন না। তার বিশ্লেষণী ক্ষমতা ছিল প্রখর। কোনো বিষয়ে তার মতামত দিতেন অকাট্য যুক্তি দিয়ে ও যথাযথ রেফারেন্সের মাধ্যমে। যেকোনো জিনিস পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে করতেন, হোক সেটা কোর্টে শুনানি অথবা বিদেশিদের সঙ্গে মিটিং বা সেমিনারে বক্তৃতা। তার মতো এমন আউটস্ট্যানডিং সিটিজেন এবং টাওয়ারিং ফিগার নিয়ে যেকোনো দেশ গর্ব করতে পারে।
বাংলাদেশের বহু যুগান্তকারী ও ঐতিহাসিক মামলা তিনি লড়েছেন, পরিচালনা করেছেন সাহস ও দক্ষতার সঙ্গে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি-সংক্রান্ত একুশে টিভির পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন মামলায় সর্বোচ্চ আদালত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে বিজয়ী হওয়ার পর লন্ডন সফরে এলে তাকে নিয়ে বাংলা মিডিয়ার সঙ্গে প্রেস কনফারেন্স করি ২০০৪ সালের গোড়ার দিকে। ওই মামলা ছিল এক যুগান্তকারী ঐতিহাসিক মামলা। দেশের প্রথম সারির আইনজীবীদের (ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার সৈয়দ ইসতিয়াক আহমদ, ব্যারিস্টার রফিকুল হক ও অ্যাডভোকেট মাহমুদুল ইসলাম প্রমুখ) হারিয়ে তিনি বিজয়ী হোন। ওই মামলায় আইনি যুক্তিতে না পেরে সর্বোচ্চ আদালতের ফুল বেঞ্চে শুনানির একপর্যায়ে ড. কামাল হোসেন ব্যারিস্টার রাজ্জাককে অনেকটা ব্যক্তিগত আক্রমণ করে ডায়াসে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘My Lords, Petitioners’ lawyer has ill political motive in this case.’ শান্তশিষ্ট ও ঠান্ডা মাথার অধিকারী ব্যক্তিত্ব ব্যারিস্টার রাজ্জাক ব্যাঘ্রের মতো গর্জে উঠে জবাব দিলেন, ‘ড. কামাল, হোলড ইউর টাং’, যা পরের দিন জাতীয় পত্রিকাগুলো হেডিং করে।
বাংলাদেশে সফরে গেলে প্রায়ই প্রধান বিচারপতিসহ সিনিয়র বিচারপতিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হতো। সবার কাছ থেকে ব্যারিস্টার রাজ্জাকের প্রশংসা শুনতাম। ২০ বছর আগে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামালকে নিয়ে লন্ডনে একটি সেমিনার করি। তাকে তার বাসা থেকে রিসিভ করে আনার প্রাক্কালে আলাপে ব্যারিস্টার রাজ্জাকের প্রশংসা করে একপর্যায়ে তিনি বলেন, বহু মানুষ হয়তো জামায়াতকে পছন্দ করে না কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমাকে পছন্দ করে।
২০০০ সালের দিকে একবার মনস্থ করেছিলাম বাংলাদেশে সেটেল্ড হয়ে সুপ্রিম কোর্টে প্র্যাকটিস করব। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কথা বললে তিনি বিনা সংকোচে রিকমেন্ড করলেন ব্যারিস্টার রাজ্জাককে। বহু বিচারপতি ও আইনজীবী ব্যারিস্টার রাজ্জাকের সুনিপুণ অ্যাডভেকেসি ও কোর্টে প্রভাববিস্তারকারী ব্যতিক্রমধর্মী সাবমিশনের প্রশংসা করতেন। তার প্রশংসা শুনেছি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন ও ব্যারিস্টার রফিকুল হকের মতো নেতৃস্থানীয় ও প্রতিথযশা আইনজীবীদের মুখে।
ব্যারিস্টার রাজ্জাকের সঙ্গে আমার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতার আরেকটি দিক ছিল—ষাটের দশকের শেষের দিকে ইসলামী ছাত্র সংঘ থেকে সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তিনি ভিপি প্রার্থী ছিলেন। আমার মামা মরহুম সিরাজুল ইসলাম (বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং ওই সময় ‘ভিপি সিরাজ’ নামে পরিচিত ছিলেন) ছাত্র ইউনিয়ন থেকে ভিপি প্রার্থী হিসেবে ব্যারিস্টার রাজ্জাকের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন এবং নির্বাচনে বিজয়ী হোন। যখনই আমার দেখা হতো তার সমসাময়িক সহপাঠী আমার মামা ও তার পরিবারের খবরাখবর নিতেন।
বিগত সরকারের হাতে নিষ্ঠুর জুলুমের শিকার হয়েছেন ব্যারিস্টার রাজ্জাক। এক দশকের ওপরে লন্ডনে নির্বাসনে থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল। ফলে দেশের সর্বোচ্চ আদালত ও জনগণ বঞ্চিত হয় তার মতো কিংবদন্তির আইনি সেবা থেকে। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তাকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে জড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। দীর্ঘদিন লন্ডনে নির্বাসনে থাকতে আওয়ামী সরকারের ইশারায় পাওয়ার অব অ্যাটর্নি সম্পাদন করতে দেয়নি লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন। অথচ এটি ছিল তার ন্যূনতম মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার। তিন-তিনবার তাকে হাইকমিশন থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ করলে তার পক্ষে রায় আসে। তারপরও সরকারের জুলুম থেকে তিনি রেহাই পাননি। তাকে ও তারেক রহমানকেই মূলত উদ্দেশ করে হঠাৎ আচমকা এক নিয়ম চালু করল তৎকালীন আওয়ামী সরকার যে, পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিতে বৈধ বাংলাদেশি পাসপোর্ট লাগবে। আবার তাদের বাংলাদেশি পাসপোর্টও দেওয়া হচ্ছিল না। এমন আজগুবি নিয়ম চালুর কারণে লাখ লাখ প্রবাসী পড়েছিলেন বিপাকে। যাহোক, ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর আমাদের প্রচেষ্টায় এবং আইন উপদেষ্টা প্রফেসর ড. আসিফ নজরুলের তত্তআবধানে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি-সংক্রান্ত জটিলতার নিরসন হয়। লাখ লাখ প্রবাসী হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন।
সব মানুষকে এই ধরা ছেড়ে যেতে হবে, আজ অথবা কাল। শতাব্দীর পরিক্রমায় আমরা যারা এই ধরায় এখন আছি, তারা কেউই থাকব না। তবে কিছু মানুষ বেঁচে থাকবেন তাদের কর্মে। ব্যারিস্টার রাজ্জাক এমনই একজন মানুষ। তিনি দীর্ঘকাল বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে তার ব্যতিক্রমধর্মী কর্মে। তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।
লেখক : বিশিষ্ট আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার