পার্বত্য চট্টগ্রামে তথাকথিত শান্তিবাহিনী ও এর উত্তরসূরি সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে আবারও অভিযোগ উঠেছে—স্থানীয় অধিবাসী ও বাঙালিদের উপর চাঁদাবাজি, হত্যাযজ্ঞ এবং উন্নয়নবিরোধী কর্মকাণ্ড চালিয়ে তারা পাহাড়ে এক ধরনের ভয়ের রাজত্ব কায়েম করেছে। স্থানীয়দের বক্তব্যে উঠে এসেছে—বাড়ি, জমি, কৃষিকাজ, ব্যবসা-বাণিজ্য এমনকি ট্রান্সপোর্ট বা ওষুধ সরবরাহ—সব ক্ষেত্রেই ট্যাক্স দিতে হয়। অন্যথায় খুন-হামলার হুমকি কিংবা বাস্তবায়ন ঘটানো হয়।
পাহাড়ের বাস্তবতা: পর্যটকের চোখের আড়ালে
বাংলাদেশের সমতল থেকে বহু মানুষ পাহাড়ে ঘুরতে যান, ছবি তোলেন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করেন। কিন্তু সেখানে চলমান সন্ত্রাস, শত শত গাছ কেটে ফেলা, পাহাড় ধ্বংস কিংবা সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাহীনতা তাদের চোখ এড়িয়ে যায়। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা না বললে বোঝা যায় না—কীভাবে প্রতিদিন চাঁদাবাজি ও হুমকির ভয়ে বেঁচে থাকতে হয়।
চাঁদাবাজি ও ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ
- বাড়িঘর ও জমি: প্রতি বছর জমির উপর দুই দফায় ট্যাক্স আদায় হয়, অভিযোগ স্থানীয় বাঙালিদের।
- ব্যবসা-বাণিজ্য: ট্রান্সপোর্টের গাড়ি ও প্রতিটি চালানের উপর আলাদা চাঁদা, বাজারের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও আদায়।
- ওষুধ সরবরাহকারী: এমনকি ঔষধ কোম্পানির প্রতিনিধি পর্যন্ত নিরাপদে কাজ করতে হলে ট্যাক্স দিতে হয়।
একজন ব্যবসায়ী বলেন—“চাহিদা মতো টাকা না দিলেই গুলি করে মারতে পারে, এমন নজির আমরা নিজের চোখে দেখেছি।”
ন্যায়বিচার ও আইনশৃঙ্খলার সীমাবদ্ধতা
স্থানীয়রা জানান—তাদের অনেক সময় থানায় গিয়ে বিচার চাইতে দেওয়া হয় না। যদি অনুমতি মেলে তবেই যেতে পারে। বাঙালিদের সাথে সম্পর্ক রাখার অভিযোগে অনেক উপজাতি পরিবারও শাস্তির মুখোমুখি হয়।
ধর্মীয় বৈষম্য: ইসলাম গ্রহণের অপরাধে হত্যার অভিযোগ
অভিযোগ রয়েছে, পাহাড়ে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করলে আপত্তি ওঠে না, কিন্তু মুসলিম হলে প্রাণনাশের হুমকি বাস্তবে রূপ নেয়। সাম্প্রতিককালে বান্দরবনের রোয়াংছড়িতে ওমর ফারুক ত্রিপুরা নামের একজন ইসলাম গ্রহণকারীকে হত্যা করা হয়েছে। তার পরিবার জানায়, বহুদিন ধরে তাকে ধর্ম ত্যাগের আল্টিমেটাম দেওয়া হচ্ছিল।
উন্নয়নবিরোধী কার্যকলাপ
স্থানীয় সূত্রের অভিযোগ—সন্ত্রাসী গোষ্ঠী পাহাড়ে রাস্তাঘাট বা পর্যটন উন্নয়ন চায় না। কারণ এতে সাধারণ পাহাড়ীরা উপকৃত হলেও সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্য কমে যাবে। এজন্য তারা পোস্টার সাঁটিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধের দাবি তোলে। অথচ পরিবেশ রক্ষার নামে প্রচারণা চালালেও একই গোষ্ঠী পাহাড় ধ্বংস, অগ্নিসংযোগ ও গাছ কাটা চালিয়ে যাচ্ছে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও হত্যাযজ্ঞ
- ৬ মে ১৯৭৭ : সাঙ্গু নদীতে কর্তব্যরত অবস্থায় আবদুল কাদিরসহ পাঁচ সেনাসদস্যকে হত্যা।
- ২৫ অক্টোবর ১৯৭৭ : বান্দরবানে নিহত হন নায়েক আবদুল গণি মিয়া, নায়েক আবদুস সাত্তার, নায়েক আরিফ, সিপাহী লুৎফর রহমান, সিপাহী আলী হোসেন এবং সিপাহী আবদুল খালেক মুন্সি।
- ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ : সাঙ্গু নদীতে অ্যামবুশ, এক সেনাসদস্যকে হত্যা এবং প্রচুর গোলাবারুদ লুট।
- ৫ জুলাই ১৯৭৯ : কাপ্তাই নতুন বাজার থেকে ২ জন আনসার সদস্যকে অপহরণ করে হত্যা।
- ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭৯ : দীঘিনালায় নায়েক এসএম রুহুল আমিনকে হত্যা।
- ১৪ অক্টোবর ১৯৭৯ : খাগড়াছড়িতে পাঁচ সেনাসদস্যকে হত্যা।
- ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭৯, লংগদু : একই রাতে একযোগে কয়েকটি গ্রামে হামলা, ২০ অ-উপজাতীয়কে হত্যা, আহত ৪০, ১০৪টি বাড়ি অগ্নিদগ্ধ।
- ২৩ জানুয়ারি ১৯৮০ : খাগড়াছড়িতে তিন সেনাসদস্য খুন, আহত ৫।
- ২১ এপ্রিল ১৯৮০ : ফালাউংপাড়া নামের একটি স্থানে অ্যামবুশ করে ১১ রাইফেল ব্যাটালিয়নের ২০ জন জওয়ানকে হত্যা, প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র লুট।
- ১ মার্চ ১৯৮০ : ঘন্টিছড়া নামের একটি স্থানে অ্যামবুশ করে হত্যা করা হয় মেজর মহসিন আলমসহ ২২ জন সেনাসদস্যকে।
- ২৫ মার্চ ১৯৮০, কাউখালী : বাঙালি বসতিতে হামলা, দুই পক্ষে নিহত ২৯, আহত ১১ জন।
- ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৮০, কাউখালী, বেতছড়ি ও কচুখালী : আকস্মিক আক্রমণে ৬ বাঙালি খুন, আহত ২৫ জন।
- ২৯ এপ্রিল ১৯৮৪ : খাগড়াছড়ি মাটিরাঙ্গায় বাঙালি বসতিতে গণহত্যা। হতাহতের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায়নি।
- ৩১ মে ১৯৮৪, বরকল : দিবাগত রাতে বাঙালি বসতিতে হামলা, ৮৮ জনকে গুলি করে হত্যা, আহত ৩৩ এবং ১৮ জন অপহৃত। আগুনে পুড়ে ছাই ২৬৪টি বাড়ি।
- ১৯ জুলাই ১৯৮৬ : খাগড়াছড়িতে এক সেনাসদস্য নিহত, আহত ৭।
- ২২ জুলাই ১৯৮৬, দীঘিনালা : সশস্ত্র হামলায় ২৪ বাঙালি খুন, ৩২ জনকে অপহরণ।
- ৭ আগস্ট ১৯৮৬ : ২ জন আনসার সদস্যকে অপহরণ করে হত্যা।
- ২১ জুন ১৯৮৭ : নাড়াইছড়ির অদূরে অ্যামবুশ, সেনাসদস্য আবদুর রাজ্জাক, ইসমাঈল হোসেন ও মোহনলালকে হত্যা।
- ২৪ নভেম্বর ১৯৮৭ : শিলছড়িতে দুই সেনাসদস্যকে গুলি করে হত্যা।
- ১৮ এপ্রিল ১৯৮৯, বাশখালী : পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষে ১৫ জনের মৃত্যু।
- ২৭ জানুয়ারি ১৯৮৯ : বন কর্মকর্তা আবুল হোসেন, বজল আহমদ ও মাহবুবুল আলমকে অপহরণ করে হত্যা।
- ৪ মে ১৯৮৯, লংগদু : আকস্মিক আক্রমণে ১৫ বাঙালির মৃত্যু।
- ১৬ এপ্রিল ১৯৯০, নাইক্ষ্যংছড়ি ও বলিপাড়া : ১৯ বাঙালিকে গুলি করে হত্যা। এ বছরই থানচিতে ১১ জন সেনা জওয়ানকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়।
- ১০ জানুয়ারি ১৯৯২, খিরাম : খিরাম বন কার্যালয়ে আক্রমণ, ৬ কর্মচারীকে হত্যা।
- ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২, লংগদু : চলন্ত লঞ্চে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ১৭ বাঙালিকে হত্যা।
- ২৯ জুন ১৯৯২ : মহালছড়ি-রাঙ্গামাটি সড়কে পাহারা চৌকির ওপর হামলা, দুজন সেনা সদস্য নিহত।
- ১৪ জুন ১৯৯৫ : শান্তিবাহিনীর ২০ সদস্যের একটি গ্রুপের হাতে ব্যাংক লুট। গার্ডকে হত্যা এবং দুই ব্যাংক কর্মচারীকে অপহরণ।
- ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬, পাকুয়াখালী (রাঙামাটি) : নৃশংস হামলা চালিয়ে ৩৫ জন বাঙালী কাঠুরিয়াকে হত্যা।
এমন শতাধিক ঘটনার অভিযোগ এখনো বিভিন্ন নথিতে সংরক্ষিত আছে।
শান্তিচুক্তির পরের চিত্র
১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তিচুক্তির অংশ হিসেবে অনেক সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়। যার ফলে পরবর্তী সময়ে পুনরায় হামলা, অপহরণ ও চাঁদাবাজি বৃদ্ধি পায় বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
বিশ্লেষণ: পাহাড়ের ভবিষ্যৎ
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পাহাড়ে প্রকৃত শান্তি ফিরিয়ে আনতে হলে—
- সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির কার্যকলাপ কঠোর হাতে দমন করা জরুরি।
- পর্যটন ও উন্নয়ন প্রকল্পে সাধারণ পাহাড়ী ও বাঙালিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
- ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার সবার জন্য সমানভাবে কার্যকর করতে হবে।
পাহাড় আজও অশান্ত। সাধারণ মানুষ ভয়, চাঁদাবাজি ও বৈষম্যের শিকার। অথচ একই সময়ে কিছু সন্ত্রাসী গোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় অতিথি হয় এবং ঢাকার সুশীল সমাজে তাদের বক্তব্যই ছড়ায়।
স্থানীয়দের ভাষায়—“আমরা চাই পাহাড়ে উন্নয়ন হোক, শান্তি হোক। কিন্তু যারা নিজেদের স্বার্থে পাহাড়কে ব্যবহার করছে, তারা চায় পাহাড় আলাদা রাষ্ট্রে পরিণত হোক।”
নোট: এ প্রতিবেদনের সব তথ্য স্থানীয় সূত্র, ইতিহাসভিত্তিক রেকর্ড ও ভুক্তভোগীদের অভিযোগের সারসংক্ষেপ। সংশ্লিষ্ট আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য সংগ্রহ করলে আরও স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যাবে।