ঢাকা আজ শুধু একটি শহর নয়, একটি মহাসমুদ্র—জনসংখ্যার ঢেউ এখানে প্রতিনিয়ত ভিড় করছে। কর্মসংস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা কিংবা নানা প্রয়োজনে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ রাজধানীতে ছুটে আসছে। এতো মানুষের আবাসন সমস্যা সমাধানের জন্য শহরে আবাসিক হোটেলের প্রয়োজন অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু এই প্রয়োজনীয়তাকে হাতিয়ার করে শহরের অলিগলিতে যে হারে আবাসিক হোটেল গড়ে উঠছে তা এখন আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজধানী ঢাকার প্রায় প্রতিটি এলাকায় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা এই হোটেলগুলোর অনেকগুলোই প্রয়োজনীয় গ্রাহক না পেয়েও ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে গিয়ে জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। আর এখানেই মূল সমস্যা—অর্থনৈতিক টিকে থাকার লড়াই ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে অপরাধের আখড়ায়। এসব হোটেল নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে অসামাজিক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। ফুটওভার ব্রিজ ও ফুটপাথে নানা রংয়ের ভিজিটিং কার্ড ছড়িয়ে খদ্দের টানা হচ্ছে, যা পথচারীদের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করছে। অনেক হোটেল আবার রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে টিকে আছে বলেও অভিযোগ স্থানীয়দের।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পুলিশি অভিযানে বারবার উঠে এসেছে চিত্রটি। দেখা গেছে, কথিত এসব আবাসিক হোটেলের উল্লেখযোগ্য অংশ মাদক সেবন ও বেচাকেনার আস্তানা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পাশাপাশি দেহ ব্যবসা প্রকাশ্যভাবে পরিচালিত হচ্ছে অনেক হোটেলে। কেবল তাই নয়, বিভিন্ন অপরাধচক্র এসব হোটেলকে ব্যবহার করছে অপরাধের পরিকল্পনা ও আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে। এমনকি চুরি, ছিনতাই কিংবা চাঁদাবাজি সংঘটিত হওয়ার পর অপরাধীরা প্রায়শই এসব হোটেলেই গা ঢাকা দেয়। ফলে স্বাভাবিকভাবে সাধারণ মানুষ এই হোটেলগুলোকে ভয় আর অবিশ্বাসের চোখে দেখতে শুরু করেছে।
ঢাকার অভিজাত আবাসিক হোটেলগুলোও অপরাধ থেকে মুক্ত নয়। বাহ্যিক চাকচিক্য আর নিরাপত্তার আড়ালে সেখানেও ঘটছে নানা অপকর্ম। ধনীর দুলালরা প্রায়ই এসব স্থানে মাদকসেবন, অনৈতিক সম্পর্ক কিংবা বেআইনি কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। ভয়ংকর সন্ত্রাসীরাও অভিজাত হোটেলকে ব্যবহার করে অপরাধ সংগঠিত করার নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে। ফলে সমস্যা কেবল নিম্নমানের হোটেলেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং উচ্চবিত্তের আড়ম্বরপূর্ণ হোটেলগুলোতেও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড গভীরভাবে প্রোথিত।
ঢাকা মহানগর পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক বছরে একাধিক অভিযানে শতাধিক আবাসিক হোটেল থেকে বিপুল পরিমাণ মাদক উদ্ধার এবং অসংখ্য নারী-পুরুষকে অনৈতিক কাজে লিপ্ত অবস্থায় আটক করা হয়েছে। চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ কিংবা রাজশাহীসহ অন্য শহরগুলোর অবস্থাও ভিন্ন নয়। চট্টগ্রামে গত বছর পুলিশের আবেদনে ১৮টি হোটেলের লাইসেন্স বাতিলের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। মোহাম্মদপুর, আদাবর বা শ্যামলী এলাকার মতো ঢাকার আবাসিক এলাকাগুলোতে প্রায় নিয়মিত এমন অভিযান চালাতে হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে, সমস্যা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি এখন নগরজীবনের এক গভীর সংকটে পরিণত হয়েছে।
প্রশ্ন হলো, কেন এমন হচ্ছে? প্রথমত, নগরজীবনে বাসা ভাড়ার খরচ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত অনেকেই স্বল্পমেয়াদে থাকার জন্য এসব হোটেলের শরণাপন্ন হন। মালিকেরা জানেন, এভাবে সবসময় গ্রাহক পাওয়া সম্ভব নয়, তাই তারা অবৈধ কর্মকাণ্ডের আশ্রয় নেন। দ্বিতীয়ত, আইনি কাঠামোর দুর্বলতা ও নিয়মিত তদারকির অভাব এ সমস্যাকে আরো বাড়িয়ে তুলছে। অনেক হোটেল লাইসেন্স ছাড়াই বছরের পর বছর ব্যবসা চালাচ্ছে। আবার লাইসেন্সপ্রাপ্ত হোটেলগুলোরও একটি বড় অংশ শর্তভঙ্গ করে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাঝে মধ্যে অভিযান চালানো হলেও দীর্ঘমেয়াদে এ ধরনের উদ্যোগ টেকসই হচ্ছে না। তৃতীয়ত, সামাজিক মানসিকতাও এখানে ভূমিকা রাখছে। অনেকে জানলেও অভিযোগ করেন না, কারণ এতে জড়িয়ে পড়তে হয় অস্বস্তিকর অবস্থায়। এ নীরবতা অপরাধীদের আরো বেপরোয়া করে তুলছে।
এর ফলশ্রুতিতে নগরের নিরাপত্তা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কোনো এলাকায় যদি পরপর কয়েকটি হোটেল অপরাধের আখড়া হয়ে যায়, সেখানকার স্বাভাবিক সামাজিক পরিবেশ ভেঙে পড়ে। আশপাশের মানুষ ভয় নিয়ে বসবাস করে, শিশু-কিশোররা অনিরাপদ বোধ করে। এলাকার ভাড়া-বাজারে প্রভাব পড়ে, অপরাধীদের দৌরাত্ম্য বাড়ে। এমনকি পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব হোটেল থেকেই পরিচালিত হচ্ছে বড় ধরনের মাদক নেটওয়ার্ক, যা নগরজীবনকে আরো অস্থির করে তুলছে।
তাহলে সমাধান কোথায়? প্রথমত, আবাসিক হোটেলের লাইসেন্স ইস্যু করার ক্ষেত্রে কঠোর মানদণ্ড প্রয়োগ করতে হবে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে যাচাই-বাছাই ছাড়া লাইসেন্স দেওয়া যাবে না। দ্বিতীয়ত, নিয়মিত তদারকি ও নজরদারি বাড়াতে হবে। শুধু অভিযানের সময় নয়, বরং প্রতিনিয়ত হোটেলগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে হবে স্থানীয় প্রশাসনকে। তৃতীয়ত, যারা হোটেল মালিক তারা সচেতন হবেন এটাই প্রত্যাশা। লাভের আশায় অপরাধীদের প্রশ্রয় দিলে অল্পকালের মধ্যেই নিজেরাই আইনের ফাঁদে পড়বেন। চতুর্থত, সামাজিক সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। কোনো এলাকায় অবৈধ কার্যকলাপ চলতে থাকলে স্থানীয় মানুষকে তা সাহসের সঙ্গে জানাতে হবে। সর্বোপরি, পুলিশের কার্যকর ভূমিকা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া এ সমস্যা থেকে মুক্তি সম্ভব নয়।
আবাসিক হোটেল একটি শহরের প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো। বিদেশ থেকে আগত পর্যটক, ব্যবসায়ী কিংবা কর্মজীবী মানুষের জন্য এটি অপরিহার্য। কিন্তু প্রয়োজনীয় জিনিস যখন অপরাধের আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে, তখন গোটা সমাজ বিপদের মুখে পড়ে। ঢাকার অলিগলিতে গজিয়ে ওঠা অসংখ্য আবাসিক হোটেল এখন সেই বিপদেরই প্রতিচ্ছবি। সঠিক পরিকল্পনা, কঠোর আইন প্রয়োগ, এবং সামাজিক অংশগ্রহণ ছাড়া এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। অন্যথায় রাজধানীকে আমরা যে নিরাপদ, বাসযোগ্য শহর হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, তা থেকে আমরা ক্রমেই আরও দূরে সরে যাব।