জুলাই বিপ্লবে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রশাসনে দেখা দেয় এক ধরনের স্থবিরতা। দীর্ঘদিন ক্ষমতার ছায়ায় থাকা আওয়ামী ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তারা হঠাৎ করেই কোণঠাসা হয়ে পড়েন। মাঠ প্রশাসন থেকে সচিবালয় পর্যন্ত অনেকেই তখন কিছু সময়ের জন্য নীরব হয়ে যান।
এই প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালের ২৮ আগস্ট দুই বছরের চুক্তিতে জনপ্রশাসন সচিব পদে নিয়োগ পান মোখলেস উর রহমান। তার নিয়োগের পর প্রশাসনে নতুন করে সক্রিয় হয়ে ওঠেন আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তারা। চারজন উপদেষ্টাও এ সময় আওয়ামী ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের রক্ষায় ভূমিকা রাখেন বলে জানা যায়।
অল্প সময়ের মধ্যেই গড়ে ওঠে এক প্রভাবশালী চক্র—যা পরিচিতি পায় ‘মোখলেস সিন্ডিকেট’ নামে। এই সিন্ডিকেট সচিবালয় ও মাঠ প্রশাসনের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি এবং বিশেষ দায়িত্ব বণ্টনে প্রভাব বিস্তার করে। অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক বিবেচনার পাশাপাশি অর্থ লেনদেনের মাধ্যমেও শতাধিক আওয়ামী ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়। ফলে প্রশাসনের ভেতরে আওয়ামী পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া শুরু হয় নতুনভাবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নথি অনুযায়ী, দায়িত্ব নেওয়ার পর মাত্র এক বছরের মধ্যেই সচিব ও সিনিয়র সচিব পর্যায়ে ৭২টি পোস্টিং অর্ডার জারি করেন মোখলেস উর রহমান, যার মধ্যে ২৫টিরও বেশি নিয়ে সৃষ্টি হয় বিতর্ক। অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, উপসচিব ও সহকারী সচিব পর্যায়েও বিপুলসংখ্যক পদায়ন হয় আওয়ামী ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের অনুকূলে।
অভিযোগ রয়েছে, ডিসি পদে নিয়োগ পেতে ৫ থেকে ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত ঘুষ লেনদেন হয়েছে। এমনকি ঘুষের চেকও উদ্ধার হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক যুগ্ম সচিবের কক্ষ থেকে। তদন্তে তিন উপদেষ্টার নেতৃত্বে কমিটি গঠিত হলেও তার ফলাফল আজও অজানা।
সূত্র জানায়, মোখলেস উর রহমান, যুগ্ম সচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ ও কে. এম. আলী আজম ছিলেন এই সিন্ডিকেটের মূল কাণ্ডারী। তারা মিলে প্রশাসনের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত কর্মকর্তাদের পরিকল্পিতভাবে বঞ্চিত করে আওয়ামী ঘনিষ্ঠদের সুবিধা দেওয়ার।
তবে সমালোচনার মুখে ২০২৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর মোখলেস উর রহমানকে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে বদলি করা হয়। কিন্তু প্রশাসনের অভ্যন্তরে তার গড়ে তোলা সিন্ডিকেটের প্রভাব এখনো রয়ে গেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রশাসনে আওয়ামী ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের পুনর্বাসন কেবল ন্যায়বিচারের পরিবেশকে দুর্বল করছে না, বরং ভবিষ্যতে রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতির নতুন সংস্কৃতি তৈরির আশঙ্কাও বাড়াচ্ছে।
সাবেক সচিব এবিএম আব্দুস সাত্তার মন্তব্য করেন, “মোখলেস সিন্ডিকেটের সময়ে প্রশাসনে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছিল। অনিয়ম-অস্বচ্ছতা ছিল সর্বত্র। এখনই তদন্ত করে দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনা দরকার।”
অন্যদিকে, সেন্টার ফর আইডিয়া ইনোভেশনের নির্বাহী প্রধান রফিক আহমেদ ডলার বলেন, “২০২৪ সালের আগস্টের পর যেসব নিয়োগ ও পদোন্নতি হয়েছে, তা পুনর্বিবেচনা জরুরি। আওয়ামী ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের পুনর্বাসন প্রশাসন ও অন্তর্বর্তী সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।”







