ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্ম হয় ইংল্যান্ডে ১৬০১ সালে। ভারতবর্ষে তাদের আগমন মোগল আমলে ১৬১০-এর দিকে। ওই সময় তারা পর্তুগিজ বণিকদের তাড়িয়ে প্রথম ঘাঁটি গাড়ে সুরাটে। ১৬১৪ সালে তাদের প্রতিনিধি টমাস রো, সম্রাট জাহাঙ্গীরের সঙ্গে এক বাণিজ্য চুক্তি সই করে। সেই চুক্তির সুবাদে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের অন্যান্য জায়গায় ব্যবসা-বাণিজ্যের ডালপালা বিস্তৃত করতে শুরু করে। তারপর প্রায় ১৫০ বছর বণিক বেশে তারা বাস করে এদেশে। অবশেষে ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে বাংলা-বিহার-ওড়িশার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে যুদ্ধে হারিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বণিক থেকে ভারতের মালিক হওয়ার পথ খোলাসা করে।
বৃহত্তর বাংলা-বিহার প্রদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শুল্কমুক্ত অবাধ বাণিজ্য প্রসারে তৎকালীন নবাব আলীবর্দী খাঁ একসময় তাদের পথের কাঁটা হয়ে ওঠেন। তাই ১৭৫২-তেই তারা সিদ্ধান্ত নেয়, ‘যে করেই হোক নবাবকে সরিয়ে কোম্পানির বশংবদ কারো হাতে সুবে বাংলার শাসনভার তুলে দিতে হবে’। ১৭৫৬ সালে নবাবের মৃত্যু হলে তার দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলা মাত্র ২৩ বছর বয়সে বাংলার শাসনভার গ্রহণ করেন। আশপাশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজনৈতিক এবং সামরিক উপস্থিতির তাৎপর্য কত ভয়াবহ এবং মারাত্মক হতে পারে যুবক নবাব তা ভালো করেই বুঝতে পারেন। তার রাজকার্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নাকগলানো নবাব খুব অপছন্দ করতেন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে একসময় নবাব কয়েকটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপন করেন। বিনা কারণে এবং নবাবের অনুমতি ছাড়া কোম্পানির লোকজন দ্বারা ফোর্ট উইলিয়ামে অতিরিক্ত অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ জড়ো করা। ১৭১৭ সালে মোগলদের থেকে পাওয়া ট্রেড পারমিটের অজুহাতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় ব্যবসার জন্য নবাবকে নিয়মমাফিক শুল্ক দিতে অস্বীকার করা। এতে নবাবের রাজস্ব আয়ে মারাত্মক ঘাটতি দেখা দেওয়া। রাজভল্লবের ছেলে চন্দ্রদাশ ঢাকায় সরকারের বিশাল অঙ্কের তহবিল তছরুপ করে পালিয়ে গেলে নবাবের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোম্পানি কর্তৃক তাকে ফোর্ট উইলিয়ামে আশ্রয় দেওয়া। এ ছাড়া কোম্পানির পক্ষে নবাবের স্বার্থের বিরুদ্ধে মাড়ওয়ারি মার্চেন্ট জগৎ শেট এবং নবাবের বিদ্রোহী খালা ঘসেটি বেগমকে সব ধরনের আশকারা দেওয়া। ইত্যাদি কারণে নবাব হওয়ার পরক্ষণেই সিরাজের সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে।
শাসনভার হাতে নেওয়ার অল্পদিনের মধ্যেই সিরাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ফোর্ট উলিয়াম দখল করে কলকাতার নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করেন। কলকাতার নাম বদলিয়ে করেন আলীনগর। ফোর্ট উলিয়ামের নাম দেন আলীনগর দুর্গ। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সে দখলদারি তিনি বেশিদিন ধরে রাখতে পারেননি। পরের বছরই ২ জানুয়ারি কর্নেল রবার্ট ক্লাইভ এবং এডমিরাল চার্লস ওয়াটসন মাদ্রাজের ফোর্ট জর্জ থেকে সৈন্যসামন্ত নিয়ে এসে ফোর্ট উলিয়াম ও কলকাতা ফের নিয়ে নেয়। একই সঙ্গে তারা ফরাসিদের হাত থেকে চন্দননগরেরও নিয়ন্ত্রণ নেয়। তারপর নবাব ৫ ফেব্রুয়ারি আবার কলকাতা আক্রমণ করেন কিন্তু প্রত্যুষে অতর্কিতে কোম্পানি বাহিনী তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে নবাবের সৈন্যরা আর সামনে এগোতে পারেনি। যুদ্ধ অমীমাংসিত থাকে এবং দুপক্ষের মধ্যে আলীনগর সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে আগের বছর নবাবের কলকাতা দখলের সময় ইংরেজদের যে ক্ষতি হয়েছিল, নবাব তা পুষিয়ে দিতে রাজি হন। ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন, স্বপ্ন থেকে বাস্তবতার দিকে আরেক ধাপ এগিয়ে যায়।
১৭৫৭ সালের ২৩ এপ্রিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কু’দে তার মাধ্যমে নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নেয়। এই উদ্দেশ্যে তারা আর্মেনিয়ান মার্চেন্ট খাজা পেট্রুসের মাধ্যমে নবাবের এক সিনিয়র জেনারেল ইয়ার লতিফ খান এবং প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খানের সঙ্গে গোপন শলাপরামর্শ শুরু করে। কাশিমবাজার কুঠির প্রধান উইলিয়াম ওয়াটসকে কূটকৌশলের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কারণ তার একটা বিশেষ সুবিধা ছিল। ইংরেজ হয়েও সে অনর্গল বাংলা এবং ফারসিতে কথা বলতে পারত। দফায় দফায় আলোচনার পর ইংরেজরা লতিফ খানের পরিবর্তে মীর জাফরকেই নবাবের উত্তরসূরি হিসেবে ঠিক করে। সেই মতো ১৭৫৭ সালের ৫ জুন ক্লাইভের সঙ্গে মীর জাফরের চূড়ান্ত গোপন ষড়যন্ত্র চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
মীর জাফর ছাড়াও ওই ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে আবদ্ধ হয় ঘসেটি বেগম, মাড়ওয়ারি মার্চেন্ট জগৎশেট, শিখ মার্চেন্ট উমিচাঁদ, রায়দুর্লভসহ অনেকে। এরা সবাই ছিল নবাবের ঘনিষ্ঠ এবং অত্যন্ত কাছের মানুষ। কাউকে ক্ষমতার টোপ এবং কাউকে টাকার লোভ দেখিয়ে ইংরেজরা তাদের বাগে আনে। তারপর ৮০০ থেকে ১০০০ ইউরোপীয়, ২০০০ থেকে ২২০০ ভারতীয় সিপাহি ও আটটি কামান নিয়ে ক্লাইভের নেতৃত্বে কোম্পানির লোকজন ১৭৫৭ সালের ১৩ জুন চন্দননগর থেকে পলাশীর দিকে যুদ্ধযাত্রা করে। পথে থেমে থেমে পাঁচ দিনে কাটোয়া দুর্গে এসে পৌঁছায়। ২২ জুন বিকেলে রওনা দিয়ে ভাগীরতী নদী পার হয়ে ২৩ তারিখ রাত ১টার সময় কলকাতা থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে নবাবের রাজধানী মুর্শিদাবাদের কাছে পলাশী নামক এক ছোট্ট গ্রামের আমবাগানে এসে ক্যাম্প স্থাপন করে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পায় সিরাজের সৈন্যরা মুর্শিদাবাদ থেকে পলাশীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের সঙ্গে আছে ১৫,০০০ অশ্বারোহী, ৩৫,০০০ পদাতিক বাহিনী এবং ফরাসিদের পরিচালনায় ৪০টি কামান। সকাল ৬টায় প্রথম নবাবের সেনাবাহিনী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ওপর কামান আক্রমণ শুরু করে। কোম্পানির লোকজন প্রথম কয়েক ঘণ্টা আত্মরক্ষায় নিরুত্তর চুপচাপ বসেছিল।
দুপুরের দিকে এক ঘণ্টার মতো প্রবল বর্ষণ হয়। এতে নবাবের কামান এবং অধিকাংশ গোলাবারুদ ভিজে জবুথবু হয়ে যায়। অন্যদিকে কোম্পানিপক্ষ তাদের অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ ঢেকে রাখায় তেমন ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি। বৃষ্টির পর নবাবের সৈন্যরা যখন ক্যাম্পে বিশ্রাম নিচ্ছিল, তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শত্রুপক্ষের ওপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভাগীরতীর পাড়ে একটু উঁচু জায়গায় নবাবের পক্ষে ফরাসিরা একটি কামান খুব কার্যকরভাবে চালাচ্ছিল, কিন্তু ইংরেজরা সেটা সহজেই দখল করে নেয়। বৃষ্টিভেজা অস্ত্রশস্ত্র আর গোলাবারুদ নিয়ে সিরাজের বাহিনী মোটেও সুবিধা করতে পারেনি। নবাবের অশ্বারোহীরা কোম্পানি গোলন্দাজ বাহিনীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। অনেকে মারাও যায়। এরই মধ্যে নবাবের গোলন্দাজ বাহিনীর কমান্ডার ও সেনা খাজাঞ্ছী মীরমদনসহ চার-পাঁচজন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কর্মকর্তা শাহাদাতবরণ করেন। নবাবের ক্যাম্পে হতাশা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।