আমি কখনো নিউ ইয়র্ক সিটিতে থাকিনি, তবে অনেকবার সেখানে গিয়েছি। আমেরিকায় প্রবেশের আমার পথ ছিল জেএফকে বিমানবন্দর। বছরের পর বছর ধরে এ শহরটি আমার কাছে চেনা হয়ে উঠেছে হাতের তালুর মতো। নিউ ইয়র্ক শহর আমার হৃদয়ে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। এটি এমন একটি শহর যেখানে স্বপ্ন ও সংগ্রাম পরস্পরের মুখোমুখি হয় এবং পরিচয় কখনোই সোজা নয়।
আমি নাইন-ইলেভেনের কয়েক সপ্তাহ আগে আমেরিকায় এসেছিলাম। সেই বছরের নভেম্বরে প্রথমবারের মতো বিদ্বেষের মুখোমুখি হই। এফডিআর হাইওয়েতে গাড়ি চালানোর সময় পাশের গাড়ি থেকে এক ব্যক্তি জানালা নামিয়ে আমাদের গাড়ির দিকে থুতু ছুড়ল এবং অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করল। আমরা কিছুই বুঝতে পারলাম না, তবে সম্ভবত কারণ ছিল আমার বন্ধুর স্ত্রীর হিজাব পরা। সেই মুহূর্তে আমি প্রথম উপলব্ধি করলাম, নিউ ইয়র্কের মতো শহরেও ইসলামবিদ্বেষ কতটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।
২৫ বছর পর মুসলিম প্রার্থী, জোহরান মামদানির ডেমোক্রেটিক মেয়রাল প্রাইমারিতে বিজয় যেন এক বিপ্লবী ঘটনা। এটি সেই পুরোনো মিথটি ভেঙে দেয়—‘তুমি যথেষ্ট নও’। এ বিজয় প্রমাণ করে, প্রতিষ্ঠান যতই শক্তিশালী হোক না কেন, বিজয় পূর্বনির্ধারিত কিছু নয়। যতক্ষণ না শেষ ভোট গোনা হয়, ততক্ষণ কাউকে বিজয়ী ঘোষণা করা যায় না।
নির্বাচনের আগের মাসগুলোয় মামদানির প্রার্থিতা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল। জানুয়ারিতে আমাকে বলা হয়েছিল, নিউ ইয়র্ক শহর এখনো নাইন-ইলেভেনের ক্ষত নিয়ে বাঁচছে। ফলে কোনো মুসলিম কখনোই নির্বাচিত হতে পারবে না। ফেব্রুয়ারিতে বলা হয়েছিল, ইসরাইলের বাইরে সর্ববৃহৎ ইহুদি জনসংখ্যা এই শহরে, তাই কোনো প্রো-প্যালেস্টাইন প্রার্থী জয়ী হতে পারে না। মার্চে আবার বলা হলো, মামদানির সোশ্যাল মিডিয়ার উপস্থিতি ভালো হলেও তা ভোটে রূপান্তর হবে না। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে এলো, মিডিয়া ও প্রতিষ্ঠানের সমর্থন জমা হতে লাগল অ্যান্ড্রু কুওমোর পক্ষে—একজন প্রাক্তন গভর্নর, এক গভর্নরের সন্তান, ব্যবসায়িক ও ইউনিয়ন শক্তির পূর্ণ সমর্থন তার পেছনে। বলা হচ্ছিল, মামদানির ভোটের সীমা ৫ থেকে ১০ শতাংশ। তিনি জিততেই পারেন না। তবু তিনি জিতেছেন।
মামদানির বিজয় শুধু একটি রাজনৈতিক অঘটন নয়; এটি এক সাংস্কৃতিক জাগরণ। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আন্ডারডগের গল্প শুধু সাহিত্য নয়, এটি বাস্তব ও চলমান এবং এই গল্প কখনো কখনো আমাদের চোখের সামনেই, আমাদের প্রাঙ্গণেই গড়ে ওঠে। আমি নিউ ইয়র্কের এই নির্বাচনী লড়াইয়ের সঙ্গে আমার প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটি বিস্ময়কর সাদৃশ্য দেখতে পাই।
প্রথমে শুনলে অযৌক্তিক মনে হতে পারে। নির্বাচনী পদ্ধতি আলাদা, জনসংখ্যার গঠন ভিন্ন। কিন্তু গভীরভাবে দেখলে, মিলগুলো অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
নিউ ইয়র্ক শহরের ভোটাররা এক বহুবর্ণ সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী : ৩৬ শতাংশ বিদেশে জন্ম নেওয়া, ৮৫ শতাংশ নাগরিক। ইহুদিরা জনসংখ্যার ১১ শতাংশ হলেও তারা প্রায় ২০ শতাংশ প্রাইমারি ভোটের অংশীদার এবং সাধারণত মধ্যপন্থি প্রার্থীদের সমর্থন করে। মুসলমানরা, যাদের সংখ্যা প্রায় ৯ লাখ, মূলত বাংলাদেশি, পাকিস্তানি, আরব ও পশ্চিম আফ্রিকান অভিবাসী, সাধারণত প্রগতিশীল রাজনীতিতে ঝুঁকে থাকেন। লাতিনো ও এশীয় কমিউনিটিও গুরুত্বপূর্ণ। নিউ ইয়র্কে জয়ী হতে হলে ধর্ম, জাতি ও অভিবাসনভিত্তিক পরিচয়ের সীমারেখা পেরিয়ে জোট গড়তে হয়।
অ্যান্ড্রু কুওমো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না, তাকে শুরুতেই বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছিল। তার পেছনে ছিল রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, অর্থবল, ওয়াল স্ট্রিটের সমর্থন এবং মিডিয়ার প্রশ্রয়। ব্লুমবার্গ তার সুপার প্যাকে মিলিয়ন ডলার ঢেলেছেন। বিল ক্লিনটন ও বড় বড় ইউনিয়ন তার পাশে। মিডিয়া তার প্রতি অনুগত। প্রতিষ্ঠানের সবাই একত্র।
এখন কুওমোর জায়গায় ‘বিএনপি’ বসান এবং নিউ ইয়র্কের জায়গায় ‘ঢাকা’। বাংলাদেশে, মিডিয়া ও ব্যবসায়িক অভিজাত শ্রেণি ইতোমধ্যেই বিএনপিকে পরবর্তী সরকার হিসেবে কল্পনা করছে, যদিও তাদের তৃণমূল ক্যাম্পেইন তেমন দৃশ্যমান নয়। ব্যাকিং পাচ্ছে প্রভাবশালী ব্যবসায়িক শক্তি, কিছু প্রো-ইন্ডিয়া অংশ এবং সুশীল মিডিয়া গোষ্ঠী।
একইভাবে, মামদানিকে যেমন নির্বাচনের অযোগ্য বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে ইসলামপন্থিদেরও তাই বলা হচ্ছে। তাদের তৃণমূল কর্মকাণ্ড ও সামাজিক অংশগ্রহণ সত্ত্বেও বারবার তাদের খাটো করা হয়েছে। যেমনÑমামদানিকে বলা হয়েছে, ‘তুমি মুসলিম বলে জিততে পারবে না,’ তেমনি জামায়াত বা অন্য ইসলামপন্থিদের বলা হয়েছে, ‘তুমি ইসলামি দল বলে জিততে পারবে না।’ মামদানি যেখানে মিডিয়ায় র্যাডিক্যাল চিত্রে চিত্রিত হয়েছেন, জামায়াতকেও একইভাবে চিত্রিত করা হচ্ছে। মামদানির বিরুদ্ধে নাইন-ইলেভেন ব্যবহৃত হয়েছে, জামায়াত বা ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে ১৯৭১।
তবে মামদানি চালিয়েছেন এক বিশ্বমানের ক্যাম্পেইন—সংগঠিত, নীতিগত ও ভীতিহীন। এটাই মূল শিক্ষা। বিজয় সম্ভব, যদি তৃণমূল সংগঠন, ইস্যুভিত্তিক বার্তা ও আত্মবিশ্বাস থাকে।
আজকের রাত শুধু মামদানির নয়। এটি তাদের সবার, যারা অপমানিত, খাটো করা হয়েছে, বাদ পড়েছে—তারা সবাই যাদের শক্তি ও ইচ্ছাশক্তিকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। এটি আমাদের শেখায়, আগাম অনুমানই বাস্তব নয়। গণতন্ত্রে কোনো ‘ধার্য বিজয়ী’ বলে কিছু নেই।
আসুন আমরা কোরআনের বাণী স্মরণ করি, সুরা আল-বাকারা, আয়াত ২৪৯ : ‘অতএব, কত ক্ষুদ্র দল কত বড় বাহিনীকে আল্লাহর আদেশে পরাজিত করেছে। আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গেই আছেন।’
এ বিজয় আমাদের মনে করিয়ে দেয়—নিউ ইয়র্ক হোক কিংবা ঢাকা, যাদের বলা হয় ‘তুমি পারবে না,’ তাদের জন্যও একদিন সময় আসে। কিন্তু শর্ত একটাই : কাউকে বিজয়ী ঘোষণা করার আগে শেষ ভোটটা গোনা হোক।
লেখক : অধ্যাপক, নর্থ ক্যারোলাইনা বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকা