ঢাকা সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ (টিটিসি) ছাত্রাবাসে সিট বাণিজ্য, চাঁদাবাজি ও শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে কলেজ ছাত্রদলের সাবেক সদস্য সচিব পিহান সরকার বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় ওই ছাত্রদল নেতাসহ ২১ জনের বিরুদ্ধে নিউমার্কেট থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন ঢাকা কলেজের ইসলামিক ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী মো. ইদ্রিস মোল্লা।
লিখিত অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, তার বন্ধু আরমান টিটিসি কলেজ ছাত্রাবাসের নতুন ভবনের ৫০০১ নম্বর কক্ষে কলেজ প্রশাসনের কাছ থেকে বৈধভাবে সিট বরাদ্দ পান। তবে ৩ জুলাই রুমে উঠতে গেলে বাধা দেন পিহান সরকার। তিনি ওই শিক্ষার্থীর কাছে ১০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন বলে জানান ওই শিক্ষার্থী। ঘটনার তিনদিন পর (৭ জুলাই) ইদ্রিসসহ কয়েকজন বন্ধু বিষয়টি মীমাংসার চেষ্টা করে পিহান সরকারের সঙ্গে দেখা করলে আবারও তিনি ১০ হাজার টাকা দাবি করেন।
লিখিত অভিযোগে আরও উল্লেখ করেন, তার বন্ধু টাকা দিতে অস্বীকার করিলে তিনি হুমকি প্রদান করে বলেন যে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস আসলেও টাকা ব্যতীত এই হলে আমি ছাড়া কেউ সিট দিতে পারবে না। পরবর্তীতে ৭ জুলাই এই বিষয়ে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে তার সাথে আলোচনা করতে গেলে তিনি পুনরায় টাকা দাবী করেন এবং ভয়ভীতি ও প্রাণ নাশের হুমকি প্রদান করেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রদল নেতা কর্তৃক হেনস্তার শিকার হওয়া শিক্ষার্থী আরমান বলেন, আমি টিটিসি কলেজে বিএড এ ভর্তির সময় বৈধভাবে সিট পাই কলেজ প্রশাসন থেকে। এরপর স্যারের কাছে গেলে আমাকে ফিহান ভাইয়ের কাছে পাঠায়। তখন উনার সাথে দেখা করলে উনি বলে স্যার এখানে সিট দিতে পারবে না। তো আমি স্যারের কাছে গেলাম, স্যার আবারো ফিহান ভাইয়ের কাছে পাঠালো। এরপর আমি ৭ তারিখে ফিহান ভাইয়ের কাছে গেলাম। তখন উনি বললো স্যার যেহেতু পাঠিয়েছে কিন্তু এখানে তো সিট নাই। কিছুক্ষণ পরে বললো তুমি আমাকে টাকা দাও, আমি তোমাকে সিট দিচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, আমি ওনাকে বললাম ভাই আমি তো লিগ্যালি সিট পেয়েছি, আমি তো ব্যাংকে টাকা পেইড করছি। উনি বলে তাহলে আর কি করার, স্যারের কাছে যাও। আর শুধু স্যার না এখানে ডক্টর ইউনুস আসলেও টাকা ব্যতিত এই হলে আমি ছাড়া কেউ সিট দিতে পারবে না। এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে আমি আমার বন্ধুদের জানায়। ৭ তারিখ রাতে বিষয়টা মীমাংসা জন্য আমার বন্ধুরা মিলে আবার ফিহানের কাছে যাই। তখনও তার একই বক্তব্য টাকা ছাড়া হলে উঠা যাবে না। আমি এখনও পর্যন্ত আমার বৈধ সিটে উঠতে পারি নাই।
এদিকে শুক্রবার (১ আগস্ট) টিটিসি কলেজের পুরাতন ছাত্রাবাসে নতুন করে ঘটনার সূত্রপাত হয়। সেখানে অবস্থানরত শিক্ষার্থী আব্দুল জব্বার তার রুমের পুরোনো খাট পরিবর্তনের চেষ্টা করলে পিহানের অনুসারী মারুফ নামের এক এক শিক্ষার্থী খাট ঢোকানোর জন্য ১০ হাজার টাকা দাবি করেন। টাকা না দেওয়ায় খাট রুমে ঢোকাতে বাধা দেওয়া হয়।
খাট ঢোকাতে বাধা পেয়ে তারা ওখানে অবস্থান করলে বিকেল ৩টার দিকে মারুফের নেতৃত্বে পিহানসহ ১৫ থেকে ২০ জন দেশি অস্ত্রশস্ত্রসহ অতর্কিতভাবে ইদ্রিস, তার ছোট ভাই সাবিদ ও আরও কয়েকজন শিক্ষার্থীর ওপর হামলা চালায়। হামলায় ইদ্রিস গুরুতর জখম হন এবং সাবিদের ডান হাতের কবজি ভেঙে যায়। পরে স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে ধানমন্ডির পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন।
অভিযোগে আরও বলা হয়, হামলাকারীদের মধ্যে মারুফ, বিয়াদ, মাহিন, মোস্তাকিন মোড়ল ও আতিকসহ অনেকে টিটিসি কলেজের পুরাতন ছাত্রাবাসে অবস্থান করছেন। তাদের অনেকের বাবার পরিচয় অজ্ঞাত এবং সবাই নিউমার্কেট থানাধীন এলাকার বাসিন্দা।
জিডির বাদি ইদ্রীস আলী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, টিটিসি কলেজ আমার বন্ধুর বৈধ সিট থাকার পরেও যখন উঠতে দেওয়া হচ্ছিল না, তার কাছে যখন টাকা দাবি করা হচ্ছিল। গত ৭ তারিখে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে যে টাকা দাবি করে ফিহান সরকার তার সাথে আমরা দেখা করি। তাকে বলা হয় যে ভাই বৈধ সিটের এলোটমেন্ট থাকার পরেও কেন হলে উঠতে দিচ্ছেন না? কেন টাকা দাবি করতেছেন? সেসময় আমরা তাকে বিভিন্নভাবে বুঝানোর চেষ্টা করি, কিন্তু সে কোনভাবেই বুঝতে চায় না। বরং আমাদেরকে বিভিন্নভাবে হুমকি দিয়েছিল।
তিনি আরও বলেন, গত ৩ দিন আগে আমার বন্ধু জব্বার যার হচ্ছে টিটিসি কলেজের পুরাতন ছাত্রাবাস ৩৩০ নাম্বার রুমে প্রশাসনের পক্ষ থেকে খাট হয়েছিল সে খাটের অবস্থা ভালো ছিল না। তো নতুন খাট ঢোকানোর জন্য বন্ধুর সহায়তার জন্য আমরা যাই। ওখানে হলের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম যাওয়ার পরে মারুফ নামে এক ছেলে পরবর্তীতে নাম জেনেছি ও আমাদের বলে যে এই খাট কোথায় ঢুকাবেন? বললাম যে আমরা বন্ধুর বৈধ সিট আছে ওর রুমে নতুন খাট ঢুকাবো। তখন সে বলে কীসের এলোটমেন্ট ? খাট ঢুকাতে পারবেন না। খাট ঢুকাতে হলে ১০ হাজার টাকা দেন। তখন আমরা বলে শুধু খাট ঢুকানোর জন্য কীসের টাকা? একপর্যায়ে সে আমাদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়। পরবর্তীতে সে হলে গিয়ে ১৫/২০ জন নিয়ে আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা করে।হামলায় করে আমাদের সহপাঠী সাবিতের ডান হাত ভেঙে দেয়। পর্ববর্তীতে আমরা থানায় যায়, মামলার আবেদন করি।
অন্যদিকে ছাত্রদল নেতা পিহানের আশ্রয়ে ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী এখনো হল দখল করে রেখেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানে হল দখল করে থাকা ছাত্রলীগ নেতাদের মধ্যে রয়েছেন– সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আল নাহিয়ান রকি (২০১৬-১৭ সেশন), যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মফিজুল ইসলাম সুজন (২০১৭-১৮), ৩ নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাজল মিঞা, সাংগঠনিক সম্পাদক ফাইয়াজ ফারুক (২০১৮-১৯) এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক নূর নোমান (২০১৬-১৭)।
অভিযোগের বিষয়ে সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ফিহান আলমের সাথে কয়েকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেন নি।
নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক টিটিসি কলেজের বিএড-এর আরেক শিক্ষার্থী বলেন, টিটিসি কলেজের হলে বর্তমানে এক বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে। এর পেছনের কারণ হলো সিট বাণিজ্য, দখলাদরিত্ব, প্রশাসনের উদাসীনতা দায়ী। বর্তমানে কলেজে বিএড সেকশনে সিট বাণিজ্যের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। এর পেছনে দায়ী রাজনৈতিক দল। হল প্রশাসন সিট দেওয়ার পরেও বর্তমানে এম এড ভবনের চার তলায় বৈধ কোন শিক্ষার্থী উঠতে পরিনি। সেটার অন্যতম কারণ ছাত্রদলের ফিহান আলম সরকার, বিয়াদ আরও অনেকেই সিট বাণিজ্যের সাথে যুক্ত আছে। এম এড ভবনের পাঁচ তলায় বহিরাগতদের রেখে অরাজকতা সৃষ্টি করছে।
তিনি আরও বলেন, একই ভবনের দুই ও তিন তলায় কোন বৈধ শিক্ষার্থী নেই। তার রুমগুলো দখল করে রেখেছে। এর ফলে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা বৈধভাবে সিট বরাদ্দ না পেয়ে বিএড ভবনের প্রতিটি রুমে গাদাগাদি করে লোক রেখে গণরুমে পরিণত করা হয়েছে। বিএড ও এমএড ভবনে আগে যে গণরুম ছিল কলেজ প্রশাসন সেগুলো উদ্ধার করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। প্রশাসনের কাছে হলের সুষ্ঠু সমাধানের জন্য গেলে তারা ছাত্রদলের কাছে যেতে বলে । বলে নিজেরা ছাত্রদলের সাথে মিউচুয়াল করে সমাধান করো। মেয়াদউত্তীর্ণ অনেক শিক্ষার্থী আছে। কিন্তু কলেজ প্রশাসন সে বিষয়ে কোন গুরুত্ব দিচ্ছে না।
সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজে ঘটনার বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ প্রফেসর রেজিয়া খাতুনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, যে অভিযোগের কথা বলছেন, তা আমার জানা নেই। তবে আমার ক্যাম্পাসের হলে উঠতে হলে কাউকে প্রশাসনিক খরচের বাইরে কোনো চাঁদা দিতে হয় না।
শিক্ষার্থীদের মারধরের বিষয়টি নিয়ে অধ্যক্ষ রেজিয়া খাতুন বলেন, ‘ওই দিন আমার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে, তা নিয়ে আমরা মীমাংসার চেষ্টা করছি। উভয়পক্ষকে সঙ্গে নিয়ে বিষয়টি মীমাংসা করব আমরা।’