হজ ও ওমরাহর অন্যতম অনুষঙ্গ তালবিয়া। হজ ও ওমরাহর জন্য ইহরাম বাঁধার সময় ও পরে তালবিয়া পড়তে হয়। ওমরাহর সময় ইহরাম বাঁধার পর থেকে তাওয়াফ শুরু করার আগপর্যন্ত তালবিয়া পড়তে হয়। হজের সময় ১০ জিলহজ কোরবানির দিন জামরাতুল আকাবায় কঙ্কর নিক্ষেপের আগ পর্যন্ত তালবিয়া পড়তে হয়। ফজল ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) জামরাতুল আকাবায় কঙ্কর নিক্ষেপ না করা পর্যন্ত তালবিয়া পাঠ করতেন। (সহিহ বুখারি: ১৫৪৪)
নবিজি (সা.) কী শব্দ ও বাক্যে তালবিয়া পাঠ করতেন তা বর্ণনা করেছেন আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.)। তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মোবারক জবান থেকে তালবিয়া শিখেছি। তিনি বলতেন,
لَبَّيْكَ اَللّهُمَّ لَبَّيْكَ – لَبَّيْكَ لاَ شَرِيْكَ لَكَ لَبَّيْكَ – اِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ – لاَ شَرِيْكَ لَكَ
উচ্চারণ: লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান-নিমাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাক।
অর্থ: আপনার ডাকে সাড়া দিয়ে আমি হাজির হে আল্লাহ! আপনার কোনো অংশীদার নেই। নিঃসন্দেহে সমস্ত প্রশংসা ও নেয়ামতরাজি আপনার এবং একচ্ছত্র আধিপত্য আপনার। আপনার কোনো অংশীদার নেই।
তালবিয়ার মাধ্যমে হজ ও ওমরাহ আদায়কারী সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাআলার দরবারে আনুগত্য প্রকাশ করে, তার ভক্তি ও ভালোবাসায় নিজেকে সমর্পণ করে। শিরক বর্জনের ঘোষণা দিয়ে এক আল্লাহর ওপর ইমান প্রকাশ করে। আল্লাহর প্রশংসা ও শুকরিয়া আদায় করে।
তালবিয়ায় ‘লাববাইক’ চারবার এসেছে। লাব্বাইক অর্থ আমি হাজির হয়েছি, আপনার ডাকে সাড়া দিয়ে আপনার দরবারে উপস্থিত হয়েছি! এটা আনুগত্য, ভক্তি ও ভালোবাসা প্রকাশ করে। এটা যেন আল্লাহর ঘরে আসার সেই দাওয়াতের জবাব যা ইবরাহিমের (আ.) মাধ্যমে পৃথিবীবাসীর প্রতি প্রেরিত হয়েছিল। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَإِذْ بَوَّأْنَا لِإِبْرَاهِيمَ مَكَانَ الْبَيْتِ أَنْ لَا تُشْرِكْ بِي شَيْئًا وَطَهِّرْ بَيْتِيَ لِلطَّائِفِينَ وَالْقَائِمِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ وَأَذِّنْ فِي النَّاسِ بِالْحَجِّ يَأْتُوكَ رِجَالًا وَعَلَى كُلِّ ضَامِرٍ يَأْتِينَ مِنْ كُلِّ فَجٍّ عَمِيقٍ لِيَشْهَدُوا مَنَافِعَ لَهُمْ وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَعْلُومَاتٍ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْبَائِسَ الْفَقِيرَ
আর স্মরণ কর, যখন আমি ইবরাহিমকে সে ঘরের (কাবা) স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম এবং বলেছিলাম, আমার সাথে কাউকে শরিক করবে না এবং আমার ঘরকে পাক সাফ রাখবে তাওয়াফকারী, রুকু-সিজদা ও দাঁড়িয়ে নামাজ আদায়কারীর জন্য। আর মানুষের নিকট হজের ঘোষণা দাও; তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং কৃশকায় উটে চড়ে দূর পথ পাড়ি দিয়ে যেন তারা নিজেদের কল্যাণের স্থানসমূহে হাজির হতে পারে এবং তিনি তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু থেকে যে রিজিক দিয়েছেন তার ওপর নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে। তোমরা তা থেকে খাও এবং দুস্থ-দরিদ্রকে খেতে দাও। (সুরা হজ: ২৬-২৮)
তালবিয়ায় দুইবার এসেছে ‘লা-শারীকা লাক’ অর্থাৎ আপনার কোনো শরিক নেই। এটা সব ধরনের শিরক বর্জন ও এক আল্লাহর ওপর ইমানের ঘোষণা। শিরক বর্জন ইমানের প্রধানতম শর্ত। শিরক আল্লাহর কাছে সবচেয়ে ঘৃণ্য ও জঘন্যতম পাপ। কোররআনে শিরকে সবচেয়ে নিকৃষ্ট জুলুম বলা হয়েছে এবং বিভিন্ন আয়াতে বারবার শিরক থেকে বেঁচে থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ সব গুনাহ ক্ষমা করলেও শিরক ক্ষমা করবেন না। আল্লাহ বলেন,
اِنَّ اللهَ لَا یَغْفِرُ اَنْ یُّشْرَكَ بِهٖ وَ یَغْفِرُ مَا دُوْنَ ذٰلِكَ لِمَنْ یَّشَآءُ وَ مَنْ یُّشْرِكْ بِاللهِ فَقَدِ افْتَرٰۤی اِثْمًا عَظِیْمًا.
নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করা ক্ষমা করেন না। এ ছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। এবং যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সে এক মহাপাপ করে। (সুরা নিসা : ৪৮)
শিরক যারা করবে, তাদের জন্য জান্নাত হারাম ঘোষণা করে আল্লাহ বলেন,
اِنَّهٗ مَنْ یُّشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللهُ عَلَیْهِ الْجَنَّةَ وَ مَاْوٰىهُ النَّارُ.
আর যে আল্লাহর সাথে শরিক করে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন এবং তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম। (সুরা মায়েদা: ৭২)
আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করে, তার ক্ষমতা ও অগণিত নেয়ামতের কথা স্বীকার করে তালবিয়ায় বলা হয়, ‘ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক’ অর্থাৎ সমস্ত প্রশংসা ও নেয়ামতরাজি আপনার এবং একচ্ছত্র আধিপত্য আপনার।
তালবিয়ার এই অংশে আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করা হয়েছে যেহেতু তিনিই সব উত্তম গুণের আধার ও সমস্ত সৌন্দর্যের উৎস। জীবন, প্রকৃতি, শক্তি, গুণাবলি—সবকিছুই তাঁর সৃষ্টি। তাই সমস্ত প্রশংসা একমাত্র তাঁরই প্রাপ্য এবং সকল প্রশংসা শেষ পর্যন্ত তাঁর দিকেই ফেরে।
এরপর বলা হয়েছে, ‘দান তোমার’—অর্থাৎ সকল নিয়ামত, শক্তি, সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্য আল্লাহরই দান। সৃষ্টিজগৎ তাঁর মুখাপেক্ষী এবং সৃষ্টির মধ্যে যা কিছু আদান-প্রদান হয়, সেটাও তাঁরই ফয়সালা।
সবশেষে বলা হয়েছে, ‘রাজত্ব একমাত্র তোমার’। গোটা সৃষ্টিজগত তাঁর হুকুমের অধীন। সৃষ্টি, পালন, ধ্বংস—সবই তাঁর ইচ্ছা ও আদেশে চলে। ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ, সব বিষয়ে তাঁরই ইচ্ছা কার্যকর হয়।