ভারত ও পাকিস্তান, উপমহাদেশের দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র, স্বাধীনতার পর থেকেই একাধিকবার সামরিক সংঘর্ষে জড়িয়েছে। কাশ্মীর নিয়ে বিরোধ, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং সামরিক আধিপত্য বিস্তারের মতো বিষয়গুলোর কারণে এই দুই দেশের সম্পর্ক সবসময়ই রুদ্ধশ্বাস।
১. প্রথম কাশ্মীর যুদ্ধ (১৯৪৭–১৯৪৮)
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম যুদ্ধটি শুরু হয় ১৯৪৭ সালে, ব্রিটিশ ভারতের বিভাজনের পরপরই। জম্মু ও কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিং স্বাধীনতা চেয়েছিলেন, কিন্তু পাকিস্তান-সমর্থিত উপজাতি ও সেনারা হঠাৎ আক্রমণ করলে তিনি ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ভারত কাশ্মীরে সেনা পাঠিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। যুদ্ধ চলে ১৯৪৮ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি হয় এবং কাশ্মীর দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে— একটি অংশ পাকিস্তান অধিকৃত আজাদ কাশ্মীর, অপরটি ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর।
২. দ্বিতীয় কাশ্মীর যুদ্ধ (১৯৬৫)
১৯৬৫ সালের এই যুদ্ধে মূলত কাশ্মীর ইস্যুই কেন্দ্রবিন্দু ছিল। পাকিস্তান গোপনে অপারেশন “জিব্রাল্টার” চালায়, যার উদ্দেশ্য ছিল কাশ্মীরি জনগণের মধ্যে বিদ্রোহ ছড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু ভারত তা প্রতিহত করে এবং সীমান্তে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধটি ছড়িয়ে পড়ে পাঞ্জাব ও রাজস্থান সীমান্তেও। প্রায় এক মাসের সংঘর্ষ শেষে সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় “টাশখন্দ চুক্তি” স্বাক্ষরিত হয়। যুদ্ধের পরিণতিতে কোনো বড় ভৌগোলিক পরিবর্তন না হলেও দুই দেশই বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
৩. তৃতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা (১৯৭১)
১৯৭১ সালের যুদ্ধটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর ফলেই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক বৈষম্য ও নিপীড়নের প্রতিবাদে গণ-আন্দোলন শুরু হয়। পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক সামরিক জান্তা সরকার ১৯৭১ সালে ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনা করে এবং নিয়মতান্ত্রিক গণহত্যা শুরু করে। ভারত শরণার্থী সংকট ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন শেষ দিকে উত্তর ভারতে পাকিস্তানের বিমান হামলার পর ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা ডিসেম্বর ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধে যোগদান করে। ফলশ্রুতিতে পূর্ব ও পশ্চিম— দুই ফ্রন্টে আরেকটি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সূচনা ঘটে। উপর্যুপরি বিমান হামলা ও বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর তৎপরতায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়ে। অবশেষে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে দীর্ঘ নয় মাসের এই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। এ যুদ্ধে পাকিস্তানের ৯৩,০০০ সৈন্য আত্মসমর্পণ করে, যা সামরিক ইতিহাসে বিরল ঘটনা। এই যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে “শিমলা চুক্তি” স্বাক্ষরিত হয়।
৪. কারগিল যুদ্ধ (১৯৯৯)
১৯৯৯ সালের মে মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তথাকথিত মুজাহিদিনরা গোপনে লাইন অফ কন্ট্রোল (LoC) অতিক্রম করে জম্মু-কাশ্মীরের কারগিল অঞ্চলে অবস্থান নেয়। ভারত বিষয়টি জানতে পারলে ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করে। এই যুদ্ধ প্রায় দুই মাস স্থায়ী হয় এবং এতে ভারত কারগিল পুনর্দখল করে। আন্তর্জাতিক মহলের চাপ এবং ভারতের প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান কূটনৈতিকভাবে ব্যাপকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এই যুদ্ধ ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য সাহসিকতা ও কৌশলের এক স্মরণীয় দৃষ্টান্ত।
অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সংঘর্ষ ও উত্তেজনা
সিয়াচেন সংঘাত (১৯৮৪–বর্তমান)
সিয়াচেন গ্লেসিয়ার নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয় ১৯৮৪ সালে। এটি বিশ্বের সর্বোচ্চ যুদ্ধক্ষেত্র। দুই দেশের সেনারা এখানে চরম প্রতিকূল আবহাওয়ায় টিকে থেকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। এখানে এখনো সংঘর্ষপূর্ণ পরিবেশ বিরাজমান।
২০১৬ উরি হামলা ও সার্জিকাল স্ট্রাইক
কাশ্মীরের উরি সেনাঘাঁটিতে জঙ্গি হামলায় ১৯ জন ভারতীয় সেনা নিহত হন। ভারত প্রথমবারের মতো “সার্জিকাল স্ট্রাইক” চালিয়ে সীমান্ত পার হয়ে সন্ত্রাসীদের ক্যাম্প ধ্বংস করে। এটি ছিল পাকিস্তানের প্রতি ভারতের এক আক্রমণাত্মক প্রতিক্রিয়া।
২০১৯ পুলওয়ামা হামলা ও বালাকোট বিমান হামলা
২০১৯ সালে পুলওয়ামায় আত্মঘাতী হামলায় ৪০ জন ভারতীয় সিআরপিএফ জওয়ান নিহত হন। এর জবাবে ভারত বালাকোটে বিমান হামলা চালায়। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান ভারতীয় যুদ্ধবিমান গুলি করে নামায়, এবং একজন পাইলট বন্দী হন, যাকে পরে মুক্তি দেওয়া হয়।
ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক এক দীর্ঘ ও উত্তেজনাপূর্ণ ইতিহাস বহন করে চলেছে, যেখানে যুদ্ধ, দমন, প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টা মিলেমিশে আছে। কাশ্মীর ইস্যু, সীমান্ত উত্তেজনা, এবং হিন্দুত্ববাদী উগ্রবাদ— এসবই সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলেছে। তবে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, সংলাপ ও আস্থা গঠনের মাধ্যমে এই দুটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ এক নতুন ভবিষ্যতের দিকে এগোতে পারে।