রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনকে ঘিরে শুরু হয়েছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। প্রায় ৩৫ বছর পর আগামী ১৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এই বহুল প্রতীক্ষিত ভোট। এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে আলোচিত প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি শক্তি হলো ছাত্রদল ও ইসলামী ছাত্রশিবির, আর মূল লড়াই হবে তাদের সমর্থিত প্যানেলের মধ্যে। ফলে বিষয়টি শিক্ষার্থীদের সীমানা ছাড়িয়ে রাজনীতি, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে।
রাকসুকে ঘিরে শিক্ষাঙ্গনে প্রাণ ফিরেছে ছাত্ররাজনীতিতে। শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে শিক্ষক, অভিভাবক এবং সাধারণ মানুষও গভীর আগ্রহ নিয়ে নির্বাচনের খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করছেন। কে কোন সংগঠন থেকে ভিপি-জিএস প্রার্থী হচ্ছেন, তা নিয়ে চলছে নানা জল্পনা। ক্যাম্পাস থেকে জেলা শহর পর্যন্ত চায়ের দোকান কিংবা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম—সবখানেই আলোচনায় রাকসু নির্বাচন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দীর্ঘ দেড় দশক ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনকাল ও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনী প্রক্রিয়ার কারণে তরুণরা ভোট থেকে বিমুখ হয়ে পড়েছিল। সেই ব্যবস্থার পতনের পর নতুন করে জনগণের মধ্যে ভোটাধিকার নিয়ে উৎসাহ তৈরি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন সেই উচ্ছ্বাসকে আরও তীব্র করেছে।
সচেতন মহল মনে করছে, রাকসু নির্বাচন শুধু ছাত্র রাজনীতির ভবিষ্যৎ নয়, দেশের সামগ্রিক রাজনীতিতেও বড় প্রভাব ফেলতে পারে। শিক্ষার্থীরা আশা করছেন, নির্বাচন হবে সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক। রাজশাহীর মানুষও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন—কারা আসবেন নেতৃত্বে এবং তার প্রভাব ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে কতটা বিস্তৃত হবে।
ইতোমধ্যেই ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ, বামপন্থী সংগঠনসহ একাধিক ছাত্র সংগঠন নিজস্ব প্যানেল নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীও হয়েছেন অনেকে। কে কোন অবস্থানে থাকবে, তা জানতে চলছে জরিপ ও চুলচেরা বিশ্লেষণ।
ডাকসু ও জাকসুর ব্যর্থতার পর ভাবমূর্তি ফেরাতে রাকসুতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে ছাত্রদল। তারা প্রচারণায় নতুনত্ব আনতে চেষ্টা করছে। অন্যদিকে ছাত্রশিবির ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’ নামে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্যানেল দিয়ে শিক্ষার্থীদের চমক দিয়েছে।
ছাত্রদল সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী শেখ নূর উদ্দিন আবীর বলেন, “রাকসুর প্রেক্ষাপট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা জাহাঙ্গীরনগরের মতো নয়। রাজশাহীর শিক্ষার্থীদের পরিবেশ ও সংস্কৃতি একেবারেই আলাদা। তাই একে আলাদাভাবে দেখতে হবে।”
অন্যদিকে ছাত্রশিবিরের ভিপি প্রার্থী মোস্তাকুর রহমান জাহিদ বলেন, “প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচন স্বতন্ত্র প্রেক্ষাপটে হয়। ডাকসু ও জাকসুতে শিক্ষার্থীরা আমাদের প্রতি যে আস্থা রেখেছেন, তা পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষারই প্রকাশ।”
এদিকে স্থানীয়দের মধ্যেও এ নির্বাচন নিয়ে উৎসাহ চোখে পড়ার মতো। রাজশাহীর আলুপট্টির এক চায়ের দোকানে রফিকুল ইসলাম বলেন, “অনেক দিন পর রাকসু নির্বাচন হচ্ছে, এতে ছাত্ররা গণতান্ত্রিক চর্চায় ফিরবে।” তবে দিনমজুর জয়নাল আবেদীন প্রশ্ন তুলেছেন, “ভোট দিলে কি সত্যিই ছাত্রদের সমস্যা কমবে, নাকি আবার আগের মতো গোলমাল হবে?”
তরুণ ব্যবসায়ী শিহাব উদ্দিন মনে করেন, যোগ্য ও সৎ ছাত্ররা নির্বাচিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ উন্নত হবে, যার সুফল সাধারণ মানুষও পাবে। প্রবীণ নাগরিক সেফাতুল্লাহর আশঙ্কা, “দলীয় প্রভাব বেশি থাকলে ছাত্রদের আসল কল্যাণ হবে না। নিরপেক্ষ নির্বাচনই কাঙ্ক্ষিত ফল আনতে পারে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক আনোয়ার হোসেন ফিরোজ বলেন, “এখন ছাত্র সংসদ নির্বাচন শুধু শিক্ষার্থীদের জন্য নয়, রাজনৈতিক দলগুলোর কাছেও মর্যাদার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে বিএনপি, জামায়াত কিংবা এনসিপির মতো দলগুলোও এ নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে সমানভাবে উদ্বিগ্ন ও প্রত্যাশী।”