ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলন করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির। এরপর ৯ মাসে বিভিন্ন বিষয়ে নানা কর্মসূচি পালনেও তাদের বন্ধন অটুট ছিল।
সর্বশেষ আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলনেও তাদের এক কাতারে দেখা গেছে। কিন্তু সরকার ফ্যাসিস্ট দলটির বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত জানানোর পর থেকে পক্ষগুলোর মধ্যে বিভাজন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কথার যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে ছাত্রদের নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি এবং জামায়াত।
এনসিপি এবং অন্তর্বর্তী সরকারে থাকা দলটির ঘনিষ্ঠ দায়িত্বশীলরা নানা বিদ্বেষমূলক কথা বলছে জামায়াত ও ছাত্রশিবিরকে জড়িয়ে। তারাও জবাব দিচ্ছে নানাভাবে। এতেই এক রকম তর্কযুদ্ধ বেধে গেছে পক্ষ দুটির মধ্যে। এনসিপি বলছে, জামায়াতকে একাত্তর প্রশ্নে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। শাহবাগে ‘গোলাম আযমের বাংলায়, আওয়ামী লীগের ঠাঁই নাই’ স্লোগান এনসিপি দেয়নি। যারা এ স্লোগান দিয়েছে তাদেরই এর দায়িত্ব নিতে হবে।
অপরদিকে জামায়াতের পক্ষ থেকে এনসিপিকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়, নবগঠিত দলটির মাথামোটা কয়েক নেতা ব্যক্তিস্বার্থে নতুন বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে। যা জুলাই বিপ্লবের ঐক্যে ফাটলের পাশাপাশি নতুন করে ফ্যাসিবাদ তৈরি করতে পারে।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে অধ্যাপক গোলাম আযমের নামে স্লোগান আর জাতীয় সংগীত পরিবেশনে বাধা সংক্রান্ত অন্তত দুটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হলে বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ে।
এতে আন্দোলনকারীদের বিজয়ে আনন্দ-উচ্ছ্বাস আর ফ্যাসিবাদের বিচার দাবি জোরদারের তৎপরতায় ছন্দপতন ঘটে। এক পর্যায়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য-বিবৃতি দেওয়া শুরু হয়। গোলাম আযমের নামে স্লোগান এবং জাতীয় সংগীতে বাধা দেওয়ার বিষয়টিও আলোচনায় আসে। একই সঙ্গে নতুন করে বিতর্কে আসে একাত্তর প্রসঙ্গ।
এনসিপি নেতাদের বক্তব্য-বিবৃতির পাশাপাশি তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের স্ট্যাটাস নিয়েও বিতর্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক বিতর্ক চলছে। এ বিষয়ে বেশ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন শিবির নেতারা। জামায়াতের নীতি-নির্ধারকরাও এ নিয়ে আলোচনা করেছেন, তবে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করেনি দলটি। এসব বিষয়ে জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে এনসিপি এবং তথ্য উপদেষ্টার প্রকাশ্য বিরোধ দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। এতে সংশ্লিষ্টদের মাঝে বেশ চাপা অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের এই সহযোদ্ধাদের মাঝে বিভেদ তৈরি করে কেউ বিশেষ ফায়দা লুটতে চায়। এতে ইসলাম ও দেশবিরোধী একটি চক্র তথা ভারতীয় কোনো এজেন্টের ইন্ধন থাকতে পারে।
গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে শুরু হওয়া আন্দোলনে বিএনপি ছাড়া জুলাই অভ্যুত্থানের সহযোগী প্রায় সব পক্ষ অংশ নেয়। এক পর্যায়ে তা শাহবাগ ব্লকেড কর্মসূচিতে রূপ নেয়। কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া জামায়াত-শিবির, হেফাজতে ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি সংগঠনের নেতাকর্মীরা তাদের সংগঠনের নাম নিয়েও স্লোগান দেয়। পরে কোনো সংগঠনের নামে স্লোগান না দিয়ে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের ও জুলাইয়ের স্লোগান দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয় মাইকে। এ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে শনিবার রাতে উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি বৈঠকের পর জানানো হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে সংশোধন আনা, বিচার না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা এবং ৩০ কর্ম দিবসের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র জারির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে সবাই আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠেন।
এ সময় শাহবাগ থেকে বাংলামোটর সড়কে অনেকে বিজয় মিছিল করেন। তবে একটি পক্ষ শাহবাগে গিয়ে অবস্থান নেন আওয়ামী লীগকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ ও জুলাই ঘোষণাপত্র জারির দাবিতে।
অন্যদিকে, বিজয় ঘোষণার প্রাক্কালে শনিবার শাহবাগের ছাত্র-জনতার অবস্থানের অন্তত দুটি ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়। তার একটিতে দেখা যায়, এনসিপি নেতারা জাতীয় সংগীত গাইতে শুরু করলে কিছু লোক বলতে থাকেনÑ ‘জাতীয় সংগীত হবে না’। গান থামাতে ব্যর্থ হয়ে তাদের ‘ভুয়া’, ‘ভুয়া’ স্লোগান দিতেও দেখা যায়।
অন্য ভিডিওতে দেখা যায়, শাহবাগের আন্দোলনের এক পাশে অবস্থান করা লোকজন ‘গোলাম আযমের বাংলায়, আওয়ামী লীগের ঠাঁই নাই’, ‘সাঈদীর বাংলায়, আওয়ামী লীগের ঠাঁই নাই’ স্লোগান দিচ্ছেন। এ নিয়ে আওয়ামী, বামসহ বিভিন্ন ঘরানার লোকজন সামাজিক মাধ্যমে বিতর্ক শুরু করেন।
পরদিন রোববার সন্ধ্যায় নিজের ভেরিফায়েড আইডিতে পোস্ট দেন তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, সেটি ৩ মিনিটের মাথায় আর পাওয়া যায়নি। তাতে বলা হয়েছিল, ‘আমাকে নিয়ে নোংরামি করতেসো, ঝামেলা নাই। ফ্যামিলি টাইনো না, যুদ্ধাপরাধের সহযোগী রাজাকারেরা। এটা লাস্ট ওয়ার্নিং। আর, যে চুপা শিবিররা এ সরকারে পদ বাগাইসো আর বিভিন্ন সুশীল ব্যানার খুলে পাকিস্তানপন্থা জারি রাখসো, তোমরা তোমাদের পূর্বপুরুষ রাজাকার আর দালালদের তুলনায় আরো অধিক ভুগবা। যারা বিতর্কের এবং গালাগালির লিমিট জানে না, তাদের আমি সহনাগরিক মনে করি না। পাকিস্তানপন্থিরা যেখানেই থাকবে, সেখানেই আঘাত করা হবে। আমৃত্যু! ঢাবিতে এ রাজাকারদের আগে ঠেকানো হবে, যারা এদের স্পেস দিসে তাদের জন্য গত পঞ্চাশ বছরের তুলনায় অধিক জিল্লতি অপেক্ষা করসে!’
এই পোস্টের পর জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের অনেক নেতাকে বিচ্ছিন্নভাবে মাহফুজ আলমের বক্তব্যের সমালোচনা করতে দেখা যায়। উপদেষ্টা পরিষদে থাকা অবস্থায় একটি দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন দাবি করে তার বিরুদ্ধে ‘শপথ ভঙ্গের’ অভিযোগও করতে দেখা গেছে। এমন প্রশ্ন তুলে শাহবাগ থানা জামায়াতের আমির শাহ মাহফুজুল হক টিভি অনুষ্ঠানে মাহফুজ আলমের ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর হয়ে কাজ করছেন কিনা– সেই প্রশ্নও তুলতে দেখা যায়।
পরে ‘দুটি কথা’ শিরোনামে মাহফুজ আলম আরেক ফেসবুক পোস্টে বলেন, ‘১. ৭১-এর প্রশ্ন মীমাংসা করতেই হবে। যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাইতে হবে। বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে পাকিস্তানপন্থা বাদ দিতে হবে। পাকিস্তান এদেশে গণহত্যা চলিয়েছে। (পাকিস্তান অফিসিয়ালি ক্ষমা
চাইলেও, তদুপরি আবারো ক্ষমা চাইতে রাজি হলেও, যুদ্ধাপরাধের সহযোগীরা এখনো ক্ষমা চায়নি)। ইনিয়ে বিনিয়ে গণহত্যার পক্ষে বয়ান উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। জুলাইয়ের শক্তির মধ্যে ঢুকে স্যাবোটাজ করা বন্ধ করতে হবে। সাফ দিলে আসতে হবে। ২. মুজিববাদী বামদের ক্ষমা নাই। লীগের গুম-খুন আর শাপলায়, মোদীবিরোধী আন্দোলনে হত্যাযজ্ঞের মস্তিষ্ক এরা। এরা থার্টি সিক্সথ ডিভিশন। জুলাইয়ের সময়ে এরা নিকৃষ্ট দালালি করেও এখন বহাল তবিয়তে আছে। আজ পর্যন্ত মুজিববাদী বামেরা কালচারালি ও ইন্টেলেকচুয়ালি জুলাইয়ের সঙ্গে গাদ্দারি করছে। দেশে বসে জুলাইয়ের পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে এরা চক্রান্ত করেই যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের এসব বিটিমও শিগগিরই পরাজিত হবে। অন্য কারো কাঁধে ভর করে লাভ নেই।’
এ বিষয়ে গত দু’দিনে ফেসবুকে আর কোনো পোস্ট করেননি মাহফুজ আলম।
অবশ্য সোমবার এক পোস্টে তিনি বলেছেন, ‘রাষ্ট্রকে নতুন করে গড়ে তুলতে অভ্যুত্থানের পক্ষের সব শক্তিকে দূরদর্শী ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলেও লড়াই এখনো বাকি আছে। মুজিববাদের সংস্কৃতি, রাজনীতি ও অর্থনীতিকে পরাস্ত করতে হবে। ফ্যাসিবাদের কারণে সৃষ্ট সামাজিক ফ্যাসিবাদ দূর করতে হবে। মজলুম জনগোষ্ঠীকে জালিম হয়ে উঠতে দেওয়া যাবে না। বরং, সবার অধিকার ও ন্যায়বিচারের পক্ষে থাকতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘একাত্তর-পরবর্তী আওয়ামী লীগ মুজিববাদের মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠনকে বাধাগ্রস্ত করেছিল এবং রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে দেউলিয়া করে। আওয়ামী লীগমুক্ত বাংলাদেশে রাষ্ট্রগঠন এবং শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠা না করতে পারলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।’
এদিকে সোমবার এনসিপির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, মত, পক্ষ এবং সাধারণ ছাত্র-জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করলেও একটি পক্ষ সচেতনভাবে দলীয় স্লোগান এবং বাংলাদেশের জনগণের ঐতিহাসিক সংগ্রাম বিরোধী স্লোগান দিয়েছে। যা জুলাই পরবর্তী সময়ে সাম্প্রতিক আন্দোলনে জাতীয় ঐক্য নবায়নের সুবর্ণ সুযোগ তৈরির ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে।
দলটির নেতারা বলছেন, ‘আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলছিÑ এনসিপির কোনো সদস্য সাম্প্রতিক আন্দোলনে দলীয় স্লোগান কিংবা এই জনপদের মানুষের সংগ্রাম ও ইতিহাসবিরোধী কোনো স্লোগান দেননি। তাই যেসব আপত্তিকর স্লোগান নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, তার দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট পক্ষটিকেই নিতে হবে। এনসিপিকে এর সঙ্গে জড়ানো সম্পূর্ণ অহেতুক ও অনাকাঙ্ক্ষিত। বরং এনসিপি সদস্যদের বক্তৃতা ও স্লোগানে এই জনপদের মানুষের ঐতিহাসিক সংগ্রামের অধ্যায় তথা ১৯৪৭, ১৯৭১ ও ২০২৪-এর প্রতিফলন ছিল। আমরা আরো লক্ষ করেছিÑ আন্দোলনকারীরা জাতীয় সংগীত পরিবেশনার সময় একটি পক্ষ আপত্তি জানালেও তারা দৃঢ়তার সঙ্গে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করে।
এনসিপি মনে করে, দেশের মানুষের ঐতিহাসিক সংগ্রামের অধ্যায়সমূহ তথা ১৯৪৭, ১৯৭১ এবং ২০২৪-এর যথাযথ স্বীকৃতি এবং মর্যাদা বাংলাদেশে রাজনীতি করার পূর্বশর্ত। যারা ১৯৭১ সালে এই জনপদের মানুষের জনযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল এবং যাদের বিরুদ্ধে গণহত্যায় সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে, আমরা চাই তারা নিজেদের সুস্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান জাতির সামনে ব্যাখ্যা করে জাতীয় সমঝোতা ও ঐক্যকে সুদৃঢ় করবে এবং চব্বিশের অভ্যুত্থানের জনআকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে সহযোগী হবে।
দলটির নেতারা আরো বলেন, এনসিপি মনে করেÑ কোনো রাজনৈতিক দল বা পক্ষের আগের রাজনৈতিক অবস্থান বা আদর্শের কারণে বিভাজন ও অনৈক্যের রাজনীতির সূত্রপাত ঘটলে সংশ্লিষ্ট দল বা পক্ষের দায় রয়েছে বাংলাদেশের মানুষের সামনে নিজেদের সুস্পষ্ট অবস্থান ব্যাখ্যা করে জাতীয় ঐক্যের পথে হাঁটার। দেশের জনগণের মধ্যকার বৃহত্তর ঐক্যের মাধ্যমেই কেবল মুজিববাদকে সামগ্রিকভাবে পরাস্ত করা সম্ভব। জনগণের সুন্দর ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য সব পক্ষকে দূরদর্শী সিদ্ধান্ত ও দায়িত্বশীল আচরণের আহবান জানায় এনসিপি।
এই অবস্থান জানানোর পর গত সোমবার রাত পর্যন্ত ফেসবুকে এনসিপির ভেরিফায়েড পেজে এ বিজ্ঞপ্তির হাইলাইট লেখা কার্ড, অস্বিত্বে বাংলাদেশ ক্যাপশন দিয়ে ৭১, ৪৭ ও ২৪ লেখা কার্ড এবং জাতীয় সংগীতের প্রথম লাইন ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ পোস্টা করা হয়েছে।
এদিকে, সোমবার ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের আহবায়ক আবু বাকের মজুমদার বলেন, ‘তোরা যারা রাজাকার, সময় থাকতে বাংলা ছাড়! লাখো শহীদের রক্তে কেনা, দেশটা কারও বাপের না! গোলাম আযম তুই রাজাকার, বাংলা কি তোর বাপ-দাদার?’
এই পোস্টের পরপরই আরেক পোস্টে গণঅভ্যুত্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক বাকের বলেন, ‘হাসিনাকে সরায়ে গোলাম আযমের জন্য আমরা জুলাইয়ে রক্ত দেই নাই।’
এদিকে মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, দেশে জাতীয় সংগীতকে অবমাননা ও একাত্তরকে উপেক্ষাকারীদের রাজনীতি বুমেরাং হবে। এনসিপি এই দুই বিষয়ে কাউকে ছাড় দেবে না। তাই যারা এখনো নানাভাবে জাতীয় সংগীত ও মুক্তিযুদ্ধকে হেয় করতে চান, এখনো সময় আছে সঠিক পথে ফিরে আসুন।
চলমান বিতর্ক সম্পর্কে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী একটি দলের চেয়ারম্যান বলেন, ‘ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমরা অনেক দল ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করেছি। আমাদের দাবি আংশিক পূরণের মধ্য দিয়ে সেটার সমাপ্তি হয়েছে। পরে যেসব স্লোগান, জাতীয় সংগীত বা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্ক করা হচ্ছে, তা অপ্রাসঙ্গিক। একসঙ্গে আন্দোলনের তিনদিন পর হঠাৎ জামায়াতের রিবুদ্ধে আঙুল তোলা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের কাজ। এটা ফ্যাসিবাদের নতুন ষড়যন্ত্র বলে মনে করি।’
তবে ঢাকা মহানগর জামায়াতের এক নেতা বলেন, এনসিপির সঙ্গে সম্পর্ক আগেও যেমন ছিল, এখনো তেমনই আছে। কয়েক নেতা ব্যক্তিস্বার্থে বিতর্কিত মন্তব্য করছেন। এ বিষয়ে জামায়াত কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না।
গোলাম আযমের নামে স্লোগান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম এ দেশের নাগরিক। দেশের রাজনীতিতে বিশেষ করে ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করতে তার অবদান রয়েছে। এজন্য তার ভক্তরা স্লোগান দিতেই পারেন। যারা তার অবদানকে ধারণ করতে পারে না, তারাই এটা নিয়ে বিতর্ক ছড়াচ্ছে।
জানা গেছে, এনসিপি নেতাদের বক্তব্য ও উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের স্ট্যাটাস নিয়ে সোমবার জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে শীর্ষনেতাদের জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া মঙ্গলবার জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের বৈঠকেও এসব বিষয়ে আলোচনা হয়। তবে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি দলটি।
এ বিষয়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের প্রধান এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, এ বিষয়ে আমরা আরেকটু সময় নিয়ে কথা বলব।
তবে দলটির আরেক কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এএইচএম হামিদুর রহমান আযাদ এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, যে স্বপ্ন নিয়ে ছাত্র-জনতা রক্ত ঝরিয়েছে, জীবন দিয়েছেÑ সে স্বপ্ন এখনো পূরণ হয়নি। যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। এ পর্যায়ে এ ধরনের পুরোনো কাসুন্দি বিভাজনমূলক কথা জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিপন্থি। এসব কথা দেশের মানুষ অনেক আগেই প্রত্যাখ্যান করেছে। এখন জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। ফ্যাসিবাদ চিরতরে নির্মূল করতে হবে।
এর আগে উপদেষ্টা মাহফুজের ওই বক্তব্যের পর নিজের ফেসবুক পেজে এক স্ট্যাটাসে কোনো উসকানি কিংবা অপ্রীতিকর ঘটনায় না জড়াতে দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিবেশ স্বাধীনতার পর থেকে কখনো কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছায়নি। সে অবস্থা এখনো অব্যাহত রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে অনেক কিছুই অনাকাঙ্ক্ষিত ও অগ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। এ অবস্থায় দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি পরামর্শ হলোÑ সর্বাবস্থায় ধৈর্য, সহনশীলতা, মহান আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল ও ইনসাফের ওপর দৃঢ় থাকার চেষ্টা করতে হবে।
উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের মন্তব্যকে উদ্দেশ্যমূলক বলছেন ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল নুরুল ইসলাম সাদ্দাম। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়ার পরপরই রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অযাচিত যে বিতর্ক তৈরি করেছেন, তাতে মনে হচ্ছে উপদেষ্টা মাহফুজ কোনো একটা উদ্দেশ্যে এ কাজ করেছেন। তার উদ্দেশ্য দ্রুত স্পষ্ট করতে হবে। তিনি সংবিধানবিরোধী কাজ করে শপথ ভঙ্গ করেছেন।
নুরুল ইসলাম আরো বলেন, ‘১৯৭৭ সালে ছাত্রশিবির প্রতিষ্ঠিত হয়। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে বা রাজাকারসংশ্লিষ্ট যে ইস্যুগুলো তিনি নিয়ে এসেছেন, এগুলো ছাত্রশিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। এ ধরনের দোষারোপ আগেও করা হয়েছে। এটা করে আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে এ দেশে ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছে। আবার যারা এ রাস্তা অবলম্বন করতে চায়, নিঃসন্দেহে দেশের জনগণ তা ভালোভাবে নেবে না। উপদেষ্টা মাহফুজ তার এ বক্তব্য প্রত্যাহার করবেন বলেও আশা করছি।’
এনসিপির সঙ্গে ছাত্রশিবিরের সম্পর্কের প্রশ্নে নুরুল ইসলাম বলেন, ‘এনসিপি যখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন হিসেবে কাজ করছিল, তখন তারা জানিয়েছিল যে তারা রাজনৈতিক সংগঠন নয়। পরে জুলাই আন্দোলনে কমন প্ল্যাটফর্ম হিসেবে আমরা গিয়েছিলাম। আর আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে হাসনাত আবদুল্লাহর ডাকে ছাত্রশিবির অংশ নেয়।’