একসময় সচ্ছল জীবন ছিল সাগর হোসেনের। কুষ্টিয়ার কুমারখালীর এই যুবকের ছিল মোটরসাইকেলের শোরুম। ছিল সুন্দর একটি আধাপাকা বাড়ি। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে সবই হারিয়েছেন।
ওই সময় প্রাথমিক তদন্ত শেষে তেজগাঁও থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. নাজমুল জান্নাত শাহ বলেন, ‘রিমন অনলাইন জুয়ায় আসক্ত। জুয়া খেলতে তিনি ক্যাফের ক্যাশ থেকে ৮৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন এবং হেরে যান। পরে টাকাটা ফেরত না দিতে তিনি আগুন লাগানোর নাটক সাজান।’
সম্প্রতি উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে অনলাইনে সব ধরনের জুয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), গোয়েন্দা বিভাগ, বিটিআরসি ও সাইবার ইউনিট এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বিভিন্ন সূত্র বলছে, সারা দেশে অনলাইন জুয়ার সঙ্গে ৫০ লাখের বেশি মানুষ জড়িত। বিটিআরসি কয়েক বছরে অবৈধ প্রায় তিন হাজার জুয়ার সাইট ব্লক করেছে। অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে দেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে হাজার কোটি টাকা। এসব অনলাইন জুয়ার সাইট দুবাই, রাশিয়া, সাইপ্রাস চীন, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পরিচালিত হয়ে আসছে। আর বাংলাদেশে আছে তাদের প্রতিনিধি।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জুয়ার বিভিন্ন চটকদার বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। এতে প্ররোচিত হয়ে অধিক আয়ের আশায় জুয়া খেলায় ঝুঁকছে মানুষ। দিন দিন অনলাইন জুয়াড়ির সংখ্যা বাড়ছে। জুয়া খেলে বেশির ভাগই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
অনলাইন জুয়ার আসক্তিতে নিঃস্ব একাধিক যুবকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অনলাইন জুয়া শুধু ব্যক্তির জীবনই ধ্বংস করছে না, এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে গোটা পরিবার ও সমাজে। পরিবারে অশান্তি, অবাধ্যতা, আর্থিক টানাপড়েন, নৈতিক অবক্ষয় বাড়ছে।
সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘তরুণসমাজের কারো কারো মধ্যে বিনা পরিশ্রমে হুট করে অধিক অর্থ উপার্জনের যে লোভ বা আকাঙ্ক্ষা, এটি তাদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সরকারের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণসহ নৈতিক শিক্ষা এবং পারিবারিক বন্ধন জোরালো না হলে এই অবক্ষয় ঠেকানো সম্ভব হবে না।’
সূত্র বলছে, অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে জুয়ার মাধ্যমে কথিত উপার্জিত টাকা দেশের অনুমোদিত কোনো ব্যাংকে লেনদেন সম্ভব নয়। এ কারণে স্থানীয় এজেন্টদের মাধ্যমে এসব কথিত জুয়ার টাকা উত্তোলন করা হচ্ছে। ভিপিএন সফটওয়্যার ব্যবহার করে রাতভর মোবাইল ফোনের অ্যাপে চলছে রমরমা জুয়ার আসর। এতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীও কোনো কূলকিনারা করতে পারছে না।
পুলিশের গোয়েন্দা ও সাইবার শাখার একাধিক কর্মকর্তা জানান, অনলাইন জুয়াচক্রের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তারা অনুসন্ধান করছেন এবং ব্যবস্থা নিচ্ছেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (গোয়েন্দা-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম-উত্তর) হাসান মোহাম্মদ নাছের রিকাবদার কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রায়ই অভিযান চালিয়ে অনলাইন জুয়াড়িদের ধরা হয়। এ ছাড়া জুয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আমাদের কাছে ভুক্তভোগীরা এলে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করি। তবে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া এই মহামারি রোধ করা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।