দেশের অন্যতম প্রধান রাজস্ব খাত—সড়ক ও সেতুর টোল সংগ্রহ—এক সময় আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী ও নেতাদের অবৈধ আয়ের বড় উৎসে পরিণত হয়েছিল। আধুনিক টোল ব্যবস্থাপনার নামে দীর্ঘদিন ধরে বিপুল সরকারি রাজস্ব লুটের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে, এবং এখনো অনেক ক্ষেত্রে সেই অনিয়মের ধারাবাহিকতা চলছে।
সূত্র জানায়, আওয়ামী শাসনামলের সাড়ে ১৫ বছরে সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম, এবং গুম-খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত মেজর জেনারেল (বরখাস্ত) জিয়াউল আহসানসহ বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা টোল খাত ঘিরে বিশাল প্রভাব ও অবৈধ সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। জুলাই বিপ্লবের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করলেও প্রশাসনের কিছু অংশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে এসব নেতা নিজেদের নিয়ন্ত্রিত কোম্পানির মাধ্যমে এখনো টোল আদায় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
অভিযোগ রয়েছে, সাবেক মন্ত্রীদের নিয়ন্ত্রিত কোম্পানি ইউডিসি, সিএনএস, শামীম এন্টারপ্রাইজ, সেল ভান, রেগনাম, এটিটি এবং পেন্টা গ্লোবালের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে রাজস্ব আত্মসাতের নানা অনিয়ম ঘটে এসেছে। সরকারি নজরদারির অভাব এবং প্রভাবশালী নেতাদের ছত্রছায়ায় এসব কোম্পানি প্রায় অডিটবিহীনভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করত। অভিযোগ অনুযায়ী, টোল আদায়ের পর তারা প্রায় অর্ধেক রাজস্ব জমা দিয়ে বাকি অর্থ আত্মসাৎ করত। এসব কর্মকাণ্ডে ভারতীয় অংশীদার প্রতিষ্ঠান ভ্যান ইনফ্রাও যুক্ত ছিল বলে জানা যায়।
সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের প্রতিষ্ঠান কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেমস (সিএনএস) দলীয় প্রভাব খাটিয়ে টেন্ডার ছাড়াই যমুনা সেতুর টোল আদায়ের দায়িত্ব নেয় এবং দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২৪ শতাংশ রেশিওতে কাজ করে। গত এক দশকে বিআরটিএ-র একাধিক প্রকল্পও পায় প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ও তারা ভৈরব, ঘোড়াশাল ও লেবুখালী সেতুর টোল নিয়ন্ত্রণ করছে।
একইভাবে সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজমের নিয়ন্ত্রণাধীন ইউডিসি কনস্ট্রাকশন বর্তমানে মেঘনা-গোমতী সেতুর টোল নিয়ন্ত্রণ করছে। এ কোম্পানি বিগত ১৭ বছর ধরে রূপসা, লালন শাহ, হাটিকুমরুল এবং কর্ণফুলী সেতুসহ একাধিক টোলপ্লাজা নিয়ন্ত্রণ করে আসছে।
এ ছাড়া ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও ব্যবসায়ী শামীমের শামীম এন্টারপ্রাইজও একইভাবে টোল ও অবকাঠামো প্রকল্পে আধিপত্য বিস্তার করেছে। মির্জা আজমের ইউডিসির সঙ্গে যৌথভাবে তারা মগবাজার উড়ালসড়ক, ঢাকা বাইপাস, বিমানবন্দর-গাজীপুর বিআরটি লেনসহ বহু প্রকল্পে কাজ নিয়েছে।
তৎকালীন যোগাযোগ সচিব নজরুল ইসলাম টেন্ডারে অনিয়ম পেয়ে বাতিল করলেও পরবর্তীতে নতুন সচিবকে প্রভাবিত করে পুনরায় অনুমোদন আদায় করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর মতে, মন্ত্রণালয় ও বিআরটিএর সার্ভার অডিট করা হলে এসব অনিয়ম স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হবে।
এশিয়ান ট্রাফিক টেকনোলজি (এটিটি) নামের আরেক কোম্পানি, যা সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, শেরপুর ও ফেঞ্চুগঞ্জ সেতুর টোল আদায়ে কোটি টাকার দুর্নীতি করে বলে সাম্প্রতিক অডিটে ধরা পড়ে। তবে তাদের বিরুদ্ধে এখনো কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
অন্যদিকে, গুম-খুনের অভিযোগে আলোচিত জিয়াউল আহসানের পেন্টা গ্লোবাল বিগত সময়ে বিভিন্ন সেতুর টোল ব্যবস্থাপনায় যুক্ত ছিল এবং এখনো নতুন দরপত্রে অংশ নিচ্ছে। একইভাবে ওবায়দুল কাদেরের আশীর্বাদপুষ্ট রেগনাম রিসোর্স এখনো চরসিন্ধুর সেতুর টোল পরিচালনা করছে।
সম্প্রতি মেঘনা-গোমতী সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগে দুদক সিএনএসের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। অভিযোগে বলা হয়, ২০১৬ সালে একক উৎসভিত্তিক চুক্তিতে সিএনএসকে টোল আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়, যার ফলে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় ৩০৯ কোটি টাকা। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ছয় মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তাসহ ১৭ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
জুলাই বিপ্লবের পরও এসব কোম্পানি অদৃশ্য প্রভাবের মাধ্যমে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা যায়। অভিযোগ রয়েছে, তারা বর্তমান প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তাকে অবৈধ সুবিধা দিয়ে দরপত্র এমনভাবে সাজাচ্ছে, যাতে নতুন কোনো কোম্পানি অংশ নিতে না পারে।
এ বিষয়ে ইউডিসি কনস্ট্রাকশনের পরিচালক কামাল আহমেদ ও রেগনাম রিসোর্সের পরিচালক মোহাম্মদ জনির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও একজন ফোন ধরেননি, অন্যজন অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করেন, তারা নিয়ম মেনে কাজ করছেন এবং কোনো রাজনৈতিক প্রভাবের আশ্রয় নেননি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “আওয়ামী লীগ আমলে রাজনৈতিক প্রভাব ও আমলাদের যোগসাজশে এই খাতে দুর্নীতি ছিল অস্বাভাবিক নয়। এখন প্রয়োজন কঠোর জবাবদিহি এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে আইনের আওতায় আনা।”
বুয়েটের অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, “রাজনৈতিক বিবেচনায় টোল পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ায় অনিয়ম বেড়েছিল। স্বচ্ছ দরপত্র, আধুনিক ব্যবস্থাপনা এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নীতিমালা ছাড়া এই খাতে শৃঙ্খলা ফিরবে না।”
