চট্টগ্রাম নগর থেকে মাত্র দশ কিলোমিটার দূরে বায়েজিদ থানার আতুরার দীপু এলাকা। সেখান থেকে আরও ভেতরে চালিতাতলীর খন্দকারপাড়া। বুধবার সন্ধ্যায় এই নীরব গ্রামেই ঘটে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড—বিএনপি প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর গণসংযোগে ঢুকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী সরওয়ার হোসেন ওরফে বাবলাকে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় অন্তত ৫০ জন সশস্ত্র ব্যক্তি। তাদের হাতে ছিল দেশীয় অস্ত্র ছাড়াও একে–৪৭ রাইফেলসহ ভারী আগ্নেয়াস্ত্র। হামলাকারীরা এসেছিল রাউজানের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে, যেখানে বড় সাজ্জাদের সহযোগীদের একটি সশস্ত্র গ্রুপের অবস্থান রয়েছে বলে জানা যায়।
খন্দকারপাড়ার নিস্তব্ধ গ্রামটি এখন শোকের ভারে স্তব্ধ। বাবলার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, উঠানে জড়ো আত্মীয়–স্বজন—কারও চোখে অশ্রু, কেউ আবার নির্বাক। বাড়ির পেছনের উঠানে পড়ে আছে বাবলার পুরোনো একজোড়া জুতা—যেন জীবনের শেষ নিঃশ্বাসের স্মৃতি বহন করছে।
পরিবার ও পুলিশ সূত্র জানায়, ৫ নভেম্বর বিএনপির গণসংযোগে বাবলার উপস্থিত থাকার কথা ছিল না। তিনি আগেই জানতে পেরেছিলেন, তাকে টার্গেট করা হয়েছে। তাই প্রার্থীকে জানিয়েছিলেন না আসার কথা। কিন্তু মাগরিবের নামাজ শেষে হঠাৎ বের হয়ে প্রার্থীর সঙ্গে দেখা হলে সিদ্ধান্ত বদলান—এবং সেই মুহূর্তেই শুরু হয় তার জীবনের শেষ অধ্যায়।
সাত মোটরসাইকেল, একটি জিপ, চার দিক থেকে ঘেরাও
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায়, অন্তত সাতটি মোটরসাইকেলে করে এলাকায় প্রবেশ করে অস্ত্রধারীরা। তাদের পেছনে আসে একটি জিপ, যাতে ছিল একে–৪৭ রাইফেল ও ভারী অস্ত্র।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, শাহ ইজ্জাতুল্লাহ জামে মসজিদের সামনে অবস্থান নেয় ৪–৫ জন পিস্তলধারী, পূর্ব মসজিদের পাশে ১০–১২ জন, হাজিরপুল এলাকায় আরও ৫–৬ জন, আর রূপনগর আবাসিকে বড় সাজ্জাদের বাড়ির কাছে প্রস্তুত থাকে ১০–১৫ জন। সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ জনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে।
গুলির শব্দে পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। মুহূর্তেই বাবলা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঘাড়ে পিস্তল ঠেকিয়ে তাকে টানা ছয় রাউন্ড গুলি করা হয়। পরে হামলাকারীরা দ্রুত পালিয়ে যায়।
বাবলার ভাই মো. ইমরান খান আজিজ অভিযোগ করে বলেন, “যে ব্যক্তি গুলি করেছে, সে বড় সাজ্জাদের ডান হাত রায়হান। এক সপ্তাহ আগেই সে বাবলাকে খুনের হুমকি দিয়েছিল। সবাই তাকে চিনেছে।”
তিনি আরও বলেন, “হত্যার পর সন্ত্রাসীরা রাউজানের পাহাড়ে ফিরে যায়। প্রশাসন জানে তাদের আস্তানা কোথায়, কিন্তু অভিযান হয় না। পাহাড় এখন সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি।”
পুরোনো বিরোধ, দীর্ঘ পরিকল্পনার ফল
পুলিশ জানায়, নিহত বাবলা নগর পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী ছিলেন। একসময় তিনি বড় সাজ্জাদের অনুসারী হলেও পরবর্তীতে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, যা পরে রক্তাক্ত শত্রুতায় রূপ নেয়। বড় সাজ্জাদের সহযোগী ছোট সাজ্জাদ এখন কারাগারে, তবে তদন্তে ইঙ্গিত মিলেছে—সে জেলখানা থেকেই হত্যার পরিকল্পনা পরিচালনা করত।
চট্টগ্রাম উত্তর পুলিশের উপকমিশনার আমিরুল ইসলাম বলেন, “ঘটনার সব দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ইতিমধ্যে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, মূল অভিযুক্তদের ধরতে অভিযান অব্যাহত।”
২০১৭ সাল থেকে হত্যার ছক
তদন্তে জানা গেছে, বাবলাকে হত্যার পরিকল্পনা বহু আগেই করা হয়েছিল। ২০১১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিঙ্গারবিলে একে–৪৭সহ গ্রেপ্তার হন বাবলা ও তার সহযোগী ম্যাক্সন। ২০১৭ সালে জামিনে মুক্ত হয়ে তারা কাতারে চলে যান এবং সেখান থেকে বাংলাদেশে চাঁদাবাজির নেটওয়ার্ক পরিচালনা করেন।
কাতারে মারামারির ঘটনায় সাজা শেষে ২০২০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বাবলাকে দেশে ফেরত পাঠায় কাতার সরকার। দেশে ফিরে তিনি রাজনীতি ও ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করলেও, তখন বড় সাজ্জাদের প্রভাব বেড়ে যায়।
বাবলার ভাই আজিজ বলেন, “ভাই ভালো পথে ফিরতে চেয়েছিল, কিন্তু তাতেই আরও ক্ষুব্ধ হয় সাজ্জাদ। একাধিকবার ব্যর্থ হয়ে শেষে ৫ নভেম্বর ৫০ জন অস্ত্রধারী নিয়ে তারা হত্যার মিশন সফল করে।”
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার সৈয়দ শাহ শরীফ বলেন, “কারাগারে নিয়ম অনুযায়ী কেবল আত্মীয়দের সাক্ষাৎ ও সীমিত ফোনকলের সুযোগ থাকে। তবে নজরদারি আরও জোরদার করা হয়েছে।”
তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, ছোট সাজ্জাদ নিয়মের ফাঁক গলে জেল থেকে বাইরে যোগাযোগ রেখে হত্যার প্রস্তুতি চালিয়েছিল।
