আমরা বর্তমানে যে সময়ে বসবাস করছি, তা নিঃসন্দেহে ডিজিটাল যুগ। এই বাস্তবতায় দেশের তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) খাতের গুরুত্ব যেমন বাড়ছে, তেমনি এই খাতের সম্ভাবনাও দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে। আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার প্রাক্কালে আমি মনে করি, আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের সুসংগঠিত বিকাশের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া অত্যাবশ্যক।
প্রথমত, প্রতিটি সরকারি মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও সংস্থার বাজেটে ‘সফটওয়্যার’ এবং ‘আইটি সেবা’ খাতের জন্য আলাদা বরাদ্দ রাখা জরুরি। দেখা গেছে, তথ্যপ্রযুক্তি বাজেটের বড় অংশটাই ব্যয় হয় হার্ডওয়্যার কেনাকাটায়, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এতে দেশীয় সফটওয়্যার ও সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রি তেমন উপকৃত হয় না। তাই আইসিটি বাজেটে সফটওয়্যার ও সার্ভিসের জন্য আলাদা খাত সংযোজন করা হোক।
দ্বিতীয়ত, দেশীয় সফটওয়্যার ব্যবহারে প্রণোদনা দেওয়া হোক। সরকারি-বেসরকারি যেসব প্রতিষ্ঠান দেশি সফটওয়্যার ব্যবহারে আগ্রহী হবে, তাদের জন্য করছাড় কিংবা বিশেষ রিবেটের মতো সুবিধা দেওয়ার কথা ভাবা যেতে পারে। এতে করে ব্যাংক, বীমা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি খাতে দেশীয় সফটওয়্যারের ব্যবহার বাড়বে এবং স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা ও আস্থা বৃদ্ধি পাবে।
তৃতীয়ত, আমরা যদি সত্যিকারের ডিজিটাল অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যেতে চাই, তাহলে ডিজিটাল লেনদেন বাড়ানোর জন্য জনসাধারণকে উৎসাহিত করতে হবে। আগামী পাঁচ বছরের জন্য একটি বরাদ্দ নির্ধারণ করা যেতে পারে (প্রতিবছর ৩০০–৫০০ কোটি টাকা), যা থেকে ডিজিটাল লেনদেনকারী ক্রেতা ও বিক্রেতাদের জন্য ক্যাশব্যাক বা অন্য কোনো আর্থিক ইনসেন্টিভ দেওয়া যাবে। এতে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ই ক্যাশের বদলে ডিজিটাল লেনদেনে বেশি উৎসাহী হবে। এর ফলে নগদ অর্থের ওপর নির্ভরতা কমবে এবং ডিজিটাল ইকোনমির প্রসার ঘটবে।
চতুর্থত, দক্ষ মানবসম্পদ এই খাতের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। দেশের তরুণদের প্রাসঙ্গিক প্রযুক্তি দক্ষতা অর্জনে প্রয়োজন বিশেষ প্রশিক্ষণ, স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম এবং ইন্ডাস্ট্রি ও একাডেমিয়ার মধ্যে কার্যকর সংযোগ। বাজেটে এই খাতে আলাদা বরাদ্দ রেখে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা জরুরি, যাতে আমাদের তরুণরা দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যেতে পারে।
পঞ্চমত, আমাদের দেশে ইতোমধ্যেই অনেক বড় ও জটিল সফটওয়্যার সিস্টেম তৈরি হয়েছেÑযেমন ড্রাইভিং লাইসেন্স ব্যবস্থাপনা, এনআইডি, হজ ম্যানেজমেন্ট, ডাটা সেন্টার পরিচালনা ইত্যাদি। এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আমরা অনেক অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশে এসব পরিষেবা রপ্তানি করতে পারি। এর জন্য সরকার যদি একটি কারিগরি সহায়তা ফান্ড গঠন করে এবং বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোকে কাজ দেওয়ার শর্তসাপেক্ষে সেই ফান্ড থেকে জি-টু-জি চুক্তির মাধ্যমে অন্য দেশে ঋণ বা অনুদান দেয়, তাহলে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অভিজ্ঞতা অর্জন হবে এবং একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির সক্ষমতা বিশ্ববাজারে তুলে ধরতে কয়েকটি দেশে মার্কেটিং অফিস স্থাপন করা প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক বা নেদারল্যান্ডস, জাপান এবং আফ্রিকার একটি দেশে স্থানীয় কর্মচারী ও বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করে এই অফিসগুলো অবিলম্বে চালু করা জরুরি। এ জন্য অন্তত পাঁচ বছরের জন্য একটা অর্থ বরাদ্দ রাখতে হবে। আর একটি বিষয়ের ওপর আমি বিশেষভাবে জোর দিতে চাই—তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি। আমাদের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী অথচ প্রযুক্তি খাতে তাদের অংশগ্রহণ খুবই সীমিত। যেসব প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে অন্তত ২৫ শতাংশ বা তার বেশি নারী কর্মী থাকবে, তাদের জন্য ট্যাক্স রিবেট, ইনসেনটিভ বা বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হোক। এতে নারী কর্মসংস্থান যেমন বাড়বে, তেমনি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল ইকোসিস্টেম গড়ে উঠবে। আমার বিশ্বাস, উপরোক্ত প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত একটি নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে পারবে। আমরা যেভাবে তৈরি পোশাক খাতে বৈশ্বিক সফলতা দেখাতে পেরেছি, ঠিক সেভাবে প্রযুক্তি খাতেও বাংলাদেশ তার সক্ষমতা প্রমাণ করতে পারবে। আসন্ন বাজেট হবে সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার সেতুবন্ধ।
লেখক : সাবেক সভাপতি, বেসিস; উপদেষ্টা ও সাবেক পরিচালক, এফবিসিসিআই; চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ আইসিটি অ্যান্ড ইনোভেশন নেটওয়ার্ক